সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
আপডেট: ১৬:৩৫, ১৮ নভেম্বর ২০২০
প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকে হাওরাঞ্চলের মানুষ
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল
বাংলাদেশের হাওর এলাকা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ জেলা। কারণ এই জেলায় রয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য হাওর। তাই এখানকার বেশির ভাগ এলাকা খুবই নিচু। সে জন্য বর্ষাকালে বেশির ভাগ জায়গা পানিতে ডুবে যায়। বন্ধ হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। তখন হাওর এলাকার মানুষ ছোট-বড় ইঞ্চিনের নৌকার মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করে থাকে।
ওই সময় হাওরের বিশাল ঢেউ এসে হাওর পাড়ে অবস্থিত ঘরবাড়ি ও গাছপালা ভেঙ্গে ফেলে। দুষ্প্রাপ্য বাঁশ, খড়, মাটি, কচুরিপানা, ঘাস দিয়েও ঘরবাড়ি রক্ষা করা সম্ভব হয়না। তখন গবাদি পশুপাখি নিয়ে চরম বিপদে পড়তে হয়। দেখা দেয় চোর ডাকাতের উপদ্রব।
বছরের প্রায় ৬ থেকে ৭ মাস পানিবন্দি হয়ে থাকতে হয় হাওরবাসীকে। তারপর শুষ্ক মৌসুম আসলে রাস্তাঘাটসহ সবকিছু আবার শুকিয়ে যায়। তখন ক্ষতিগ্রস্ত কাঁচা-পাকা সড়ক দিয়ে যাতায়াত করতে গিয়ে পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।
মহামারী করোনাভাইরাস যখন সারা বিশ্ববাসীকে গ্রাস করে নিচ্ছে, তখন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে হাজির হয় বন্যা। তাও আবার ১ বার ২ বার নয়। এক সপ্তাহ ও ১৫ দিনের ব্যবধানে ২ মাসের ভিতরে পরপর ৫ বার বন্যা হয় চলতি বছরে। তাতে এই হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে।
প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত এভাবেই লড়াই করতে হয় সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মানুষকে।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের বসবাস। তবে এই জেলার সবচেয়ে অবহেলিত উপজেলা হচ্ছে-তাহিরপুর,বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা-মধ্যনগর ও দিরাই-শাল্লা।
হাওর সমৃদ্ধ এসব উপজেলার বেশির ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু সঠিক সময়ে হাওরের বেড়ি বাঁধ নির্মাণ না করার কারণে পাহাড়ী ঢলের পানিতে প্রতি বছরই ডুবে যায় হাজার হাজার একর ফসলী জমি। যার ফলে বেশির ভাগ কৃষকই নিঃস্ব হয়ে যায়। পরে জীবন বাঁচানোর তাগিদে কোন উপায় না পেয়ে হাওরের পানিতে মাছ ধরতে বাধ্য হয় কৃষকরা।
কিন্তু হাওরের পানিতে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। অবাধে কারেন্ট জাল ব্যবহারের কারণে মাছের অস্তিত্ব ধ্বংসের পথে। তাই না খেয়ে অনেকেই দিন কাটায়। বর্ষাকালে হাওরের মাঝে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দূর থেকে দেখলে দ্বীপের মত মনে হয়। এসময় ক্ষতিগ্রস্ত পাকা সড়ক দিয়ে উপজেলা সদর থেকে জেলা শহরে কোন রকম যাতায়াত করা গেলেও উপজেলা সদরের সাথে বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। তাই ছোট-বড় ইঞ্জিনের নৌকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে হয় হাওরের মানুষদের।
হাওর এলাকার প্রধান সমস্যা হচ্ছে অকাল বন্যা ও ফসলহানী। এছাড়াও রয়েছে বর্ষাকালের সমুদ্রাকৃতির বিশাল ঢেউ। আর বন্যা দেখা দিলে হাওর এলাকার মানুষের দুর্ভোগের কোন শেষ থাকে না। এসময় তারা ঘরের ভিতর বাঁশ দিয়ে মাচা তৈরি করে বসবাস করে। আর পানির পরিমাণ বেশি বাড়লে কেউ কলার ভেলায় আবার অনেকেই নৌকার মাঝে আশ্রয় নেয়। তবে বন্যার সময় হাওর এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় অসহায় মানুষের আশ্রয় কেন্দ্রে।
এসময় কোন মানুষ মারা গেলে তার মৃতদেহ দাফন-কাফন কিংবা সৎকারের ব্যবস্থা থাকে না। দেখা দেয় গো-খাদ্য,জ্বালানী কাঠ ও শুকনো খাবারসহ বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট । পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে হাওরের গ্রামগুলো বিদ্যুতায়িত হলেও বেশির ভাগ গ্রাম থাকে অন্ধকারে। কারণ সঠিক ভাবে বিদ্যুৎ দেওয়া হয় না। এসময় হাওরাঞ্চলে বেড়ে যায় চোর ডাকাতের উপদ্রব। নৌকা যোগে ডাকাতরা এসে গ্রামগুলোতে হানা দেয়। এলাকার মানুষ সারারাত জেগে পাহারা দিয়েও রক্ষা করতে পারে না তাদের মূল্যবান সম্পদ।
এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকা গুলোদেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায়, শিক্ষার দিক দিয়ে রয়েছে অনেক পিছিয়ে। বর্তমানে করোনা মহামারীর কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাস দেখা দেওয়ার আগে থেকেই এই হাওরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের অবহেলার কারণে প্রতি বছরই ঝরে পড়ছে হাজার হাজার শিশু শিক্ষার্থী। কারণ শিক্ষা কর্মকর্তারা নিয়মিত স্কুল পরিদর্শন ও তদারকি না করার কারণে শিক্ষকরা নিয়মিত স্কুলে যায় না।
বেশিরভাগ শিক্ষকরা স্কুল রেখে নিজেদের প্রাইভেট কোটিং সেন্টার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সেই সাথে রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আরো নানান কাজে জড়িত। তাছাড়া হাওর এলাকা গুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট সারা বছরই লেগে থাকে।
বিশুদ্ধ খাবার পানি না পাওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে হাওর ও পুকুরের পানি পান করতে হয় হাওরবাসীকে। এছাড়া বেশির ভাগ মানুষ খোলা ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। এ কারণে ডায়রিয়া,আমাশয় ও কলেরাসহ নানাবিধ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয় তারা।
কিন্তু উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ডাক্তার-নার্স ও ঔষধ না থাকার কারণে চিকিৎসা সেবা থেকে ও বঞ্চিত হচ্ছে হাওরবাসী। এসব নানাবিধ সমস্যার সাথে লড়াই করে প্রতিনিয়ত বেঁচে আছে সুনামগঞ্জ জেলার হাওর এলাকার লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ। কিন্তু তাদের সমাধান করার মতো কেউ নেই।
এ ব্যাপারে তাহিরপুর জয়নাল আবেদীন মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক আলী মর্তুজা বলেন-বর্তমান সরকার সারাদেশের উন্নয়নের জন্য যে ভূমিকা নিয়েছেন তা খুবই প্রশংসনীয়। কিন্তু হাওরের বেরী বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলার কারণে কৃষকদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। তাছাড়া জেলা শহর ও উপজেলা সদরের রাস্তাঘাট ভাঙ্গা। সেগুলো দ্রুত মেরামত করাসহ স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করা জরুরী প্রয়োজন।
জামালগঞ্জ উপজেলার প্রবীন সাংবাদিক ও কৃষক তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ বলেন- হাওর বলতে আমরা বুঝি ধান ও বিভিন্ন প্রকার ফসল চাষাবাদের এলাকা। কিন্তু হাওরের বেরী বাঁধগুলো কখনোই সঠিক ভাবে নির্মাণ করা হয় না। তাছাড়া হাওর এলাকাগুলোর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তাররা এসে বেশি দিন থাকে না। অন্যত্র বদলি হয়ে চলে যায়। যার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে সব সময় আমরা বঞ্চিত।
এছাড়া জামালগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ যাতায়তের প্রধান সড়কসহবেশির ভাগ সড়কই যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী। এসব সমস্যা দীর্ঘদিনের হলেও আজ পর্যন্ত তার সমাধান হয় নি। যার কারণে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে হাওরবাসীকে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আব্দুল আহাদ বলেন-হাওরের মাছ ও প্রাণীর উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ধানের ওপর নির্ভর করে হাওরবাসী জীবন চলবে না। এছাড়া হাওর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর তথ্য নিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সেগুলোর সংস্কার করা হবে। আর অন্যান্য বিষয়ের ওপর তদারকি চলছে।
আইনিউজ/মোজাম্মেল আলম ভূঁইয়া
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’
- করোনা জয় করে সুস্থ হয়েছেন মৌলভীবাজারের ৩ চিকিৎসক