Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৫ জুলাই ২০২৫,   আষাঢ় ৩০ ১৪৩২

ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯:৪১, ১০ মে ২০২২

ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পথে বংবং মার্কোস

৬৪ বছর বয়সী ফার্দিনান্দ মার্কোস জুনিয়র, যিনি তার বংবং নামেই বেশি পরিচিত, তিনি ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পথে। তাঁর বাবা ছিলেন এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। তাঁর মা আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি কুড়িয়েছিলেন তার জুতার বিশাল সংগ্রহের জন্য। তাও আংশিক ও বেসরকারি ফলাফল বলছে, তিনি প্রায় ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতে গেছেন।

এ বিষয়ে জেনে আসা যাক বিবিসির একটী প্রতিবেদন থেকে।

একটি স্বর্ণ-মুকুট এবং সাদা ঘোড়া

ফিলিপিনের ইলোকোস নর্তে অঞ্চলটি মার্কোস পরিবারের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। সেখানে স্প্যানিশ কায়দায় তৈরি এক রাজকীয় প্রাসাদ, যেটিকে বর্ণনা করা হয় উত্তরের মালাচিয়াং প্রাসাদ বলে।

মূল মালাচিয়াং প্রাসাদ আসলে হাজার মাইল দূরে রাজধানী ম্যানিলায়, এটি ফিলিপিনের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন। তবে ফার্দিনান্দ মার্কোস যখন ফিলিপিন শাসন করছেন, তখন ১৯৬০ এর দশকে ইলোকোস নর্তের এই প্রাসাদটি তাঁর পরিবারকে উপহার দেয় দেশটির পর্যটন কর্তৃপক্ষ।

তবে মার্কোস পরিবারের তীর্থ বলে পরিচিত এই প্রাসাদোপম বাড়ি এখন জনগণের জন্য উন্মুক্ত। মার্কোসের সমর্থকরা এখানে এসে ফার্দিনান্দ এবং ইমেলদা মার্কোসের রাজকীয় ছবির সামনে সেলফি তোলে, তাদের থাকার ঘরগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে।

বংবং শৈশবে যে ঘরটিতে থাকতেন, সেখানে একটি কারুকার্যখচিত খাটের বিপরীতে ঝোলানো তার একটি ছবি, ফিলিপিনের সম্ভাব্য ভাবী নেতার এক অসাধারণ প্রতিকৃতি।

ছবিতে বংবং একটি স্বর্ণ-মুকুট পরে আছেন, তিনি একটি সাদা স্ট্যালিয়ন ঘোড়ায় চড়ে মেঘের রাজ্যে চলেছেন। তাঁর এক হাতে ফিলিপিনের পতাকা, অন্য হাতে বাইবেল।

এই পেইন্টিং এর কোণায় যে স্তোত্র লেখা, তা ছবিটির মর্মার্থ বুঝতে সাহায্য করবে: এপো ২১:১, এতে পবিত্র নগরী জেরুজালেমের ওপর দিয়ে এক স্বর্গ-দূতের উড়ে যাওয়ার বর্ণনা দেয়া আছে।

এক গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৮৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ফার্দিনান্দ মার্কোস। এ পরিবার বিশ্বজুড়ে কুখ্যাতি অর্জন করে তাদের দুর্নীতির জন্য।

তাঁর শাসনামলে ফিলিপিনে কী ব্যাপক দুর্নীতি আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল, আদালতের রেকর্ড আর সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে তার বিস্তারিত বিবরণ এবং প্রমাণ আছে।

গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী কর্মীরা যখন ম্যানিলায় প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে ঢুকে পড়েছিল, তখন সেখানে মার্কোস পরিবারের বহু চমৎকার তৈলচিত্র, সোনায় মোড়ানো জাকুজি, ১৫টি মিংক কোট, ৫০৮টি ডিজাইনার গাউন, এবং ফার্স্ট লেডি ইমেলদা মার্কোসের তিন হাজার জোড়া জুতার সংগ্রহ দেখতে পান।

কিন্তু সেই পরিবারেরই সন্তান বংবং এরই মধ্যে ফিলিপিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেসরকারি ফলাফলে ভূমিধস জয় পেয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা যখন চলছিল বিপুল উদ্যমে, তখন সমর্থকরা অতীতের এসব ঘটনা এবং তথ্য সম্পর্কে তাদের সংশয় প্রকাশ করছিলেন।

বংবং এর বিরোধী শিবিরের লোকজন এজন্য দায়ী করছেন সোশ্যাল মিডিয়াকে। তাদের মতে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মিথ্যে তথ্য ছড়িয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, মার্কোস পরিবারের কলঙ্কময় অতীত মুছে ফেলা হয়েছে। তবে মার্কোস পরিবার এই অভিযোগ অস্বীকার করেন।

বহু বছর ধরেই ফেসবুকে ভুয়া একাউন্ট আর নানা রকমের প্রোপাগান্ডা পোস্ট দিয়ে চালানো হচ্ছে মার্কোস পরিবারের গুণকীর্তন। এসব পোস্টে অতীত ইতিহাসকে এতটাই ব্যাপকভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে, লোকে এসব ভুল তথ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, তোতাপাখির মতো সেগুলোকেই সত্য বলে পুনরাবৃত্তি করে।

এসব পোস্টে সাধারণভাবে একটা কথাই বেশি করে বলা হয়: মার্কোসের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলটাই ছিল আসলে ফিলিপিনের 'স্বর্ণযুগ'- যদিও আসলে তখন ফিলিপিনের অর্থনীতি ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, এবং দেশটি ছিল বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছে বিপুলভাবে ঋণগ্রস্ত।

আনুগত্য এবং উত্তরাধিকা

রাজধানী ম্যানিলার ৭১ বছর বয়সী জেসাস বাতিস্তা একজন কট্টর বংবং সমর্থক। মিস্টার বাতিস্তা একসময় ম্যানিলার আবর্জনার স্তূপে জিনিস কুড়াতেন। সেখানে আবর্জনার যে পাহাড় জমতো, তাতে অনেক সময় আগুন ধরে যেত, তাই এটিকে ধোঁয়ার পাহাড়ও বলতো অনেকে।

১৯৮৩ সালে তাকে ম্যানিলার ট্রাফিক আইন কার্যকর দফতরে অবসর ভাতার সুবিধাসহ একটি পূর্ণকালীন চাকুরি দেয়া হয়। মিসেস মার্কোসকে তখন মেট্রো ম্যানিলার গভর্নর করা হয়েছিল অগণতান্ত্রিক-ভাবে।

নিজের ভাঙা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে মিস্টার বাতিস্তা বলেন, এরকম একটা সরকারি চাকুরি যে পেয়েছিলেন, সেজন্যে ইমেলদার কাছে তাঁর অনেক ঋণ, তিনি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

প্রায় দশ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলারের সম্পদ লুটপাটের এক দুর্নীতির কারণে পরবর্তীকালে ইমেলদা মার্কোসের সাজা হলেও, জেসাস বাতিস্তা এবারের নির্বাচনে তার ছেলেকেই ভোট দেবেন বলে জানান।

"আমি তো কখনো কোন দুর্নীতি দেখিনি", বললেন মিস্টার বাতিস্তা। "এগুলো সব শোনা কথা। শত্রুরা তাদের নামকে কালিমালিপ্ত করতে চেয়েছে", বলছেন তিনি।

তিন হাজার জোড়া জুতা

বিক্ষুব্ধ জনতা যখন মার্কোসের প্রাসাদে ঢুকে পড়েছিল, তখন সেই ঘটনা যেসব রিপোর্টার প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাদের একজন মার্কিন সাংবাদিক জিম লরি।

"ইমেলদার সাজঘরে গিয়ে দেখা গেল সেখানে শত শত ডিজাইনার গাউন, সেখানে নিউ ইয়র্ক, প্যারিস বা রোমের নামকরা সব ফ্যাশন ব্রান্ডের লেবেল তখনো ছেঁড়া হয়নি অনেক পোশাক থেকে। তিনি হয়তো সেগুলো একবারও পরেন নি, ... আর ফিলিপিন তো এক অর্থে খুবই গরীব এক দেশ.. যখন আপনি এর সঙ্গে তুলনা করে বিষয়টি দেখবেন, তখন বুঝতে পারবেন এই বিলাসিতা কতটা অশ্লীল, কতটা দৃষ্টিকটু", বলছেন তিনি।

তবে এই বিষয়টি ছিল দুর্নীতির ব্যাপকতার একটি ক্ষুদ্র প্রমাণ মাত্র।

মার্কোস পরিবার কীভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বেআইনিভাবে সুইস ব্যাংকে পাচার করেছে, কীভাবে নিউ ইয়র্কের অভিজাত এলাকা ম্যানহাটানে কয়েকটি বাড়ি কিনেছে, তার দলিলও পাওয়া গিয়েছিল।

তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়। কিছু মামলায় পরিবারের সদস্যদের দণ্ড হয়, অন্য কিছু মামলায় তারা খালাস পান।

এর মধ্যে ১৯৯০ সালে নিউ ইয়র্কে প্রতারণার আলোচিত একটি মামলায় মিসেস মার্কোস জুরিদের বিচারে খালাস পান এবং তিনি আবার ফিলিপিনে ফিরে আসেন।

নেতা হওয়ার জন্যই জন্ম

বংবং এর জন্মই যেন হয়েছে নেতা হওয়ার জন্য, সেভাবেই ছোটবেলা থেকে তাকে বড় করা হয়।

গণবিক্ষোভের মুখে ১৯৮৬ সালে যেদিন মার্কোস পরিবারকে প্রাসাদ ছাড়তে হয়, সেদিনের কিছু ফুটেজে দেখা যায়, ২৮ বছর বয়সী বংবং সামরিক পোশাকে তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

তবে ১৯৭২ সালে ফার্দিনান্দ মার্কোসের এক ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বেশ উৎকণ্ঠার ভুগতেন। এতে তিনি লিখেছেন, "বংবংকে নিয়েই আমাদের বেশি চিন্তা। ও খুব বেশি বেপরোয়া আর অলস।"

বংবং ১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফিলজফি, পলিটিক্স এন্ড ইকোনোমিক্স (পিপিই) পড়ার জন্য, যেটিকে রাজনীতিতে কেরিয়ার গড়ার জন্য আদর্শ একটি কোর্স বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারেন নি- যদিও বংবং তা অস্বীকার করেন।

ফিলিপিনের একটি নিউজ ওয়েবসাইট ভেরাফাইলসের এক রিপোর্ট অনুসারে, বংবং যখন দুবার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন, তখন নাকি ফিলিপিনের তৎকালীন কূটনীতিকরা লবিং করেছিলেন যেন তাকে অন্তত সোশ্যাল সায়েন্সে একটা স্পেশাল ডিপ্লোমা ডিগ্রি দেয়া হয়।

এই বিতর্ক সত্ত্বেও পিতার শাসনামলে রাজনীতিতে এক জাঁকালো কেরিয়ার গড়তে বংবং এর কোন অসুবিধা হয়নি। তবে গণঅভ্যুত্থানে মার্কোস পরিবার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এতে ছেদ পড়েছিল।

তবে দেশে ফিরে আসার পর ফিলিপিনের রাজনীতিতে দিনে দিনে বংবং এর অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে।

বংবংএর রানিং মেট দুতার্তের মেয়ে

নির্বাচনে বংবং এর রানিং মেট হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৩ বছর বয়সী সারা দুতার্তে, যিনি ফিলিপিনের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তের মেয়ে।

মিস্টার দুতার্তে খুবই বিতর্কিত, কিন্তু জনপ্রিয় এক প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ফিলিপিনের সংবিধান অনুযায়ী, একজন প্রেসিডেন্ট ছয় বছরের মেয়াদ শেষ করার পর আর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রার্থী হতে পারেন না।

প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ২০১৬ সালে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করেছিলেন। তখন হাজার হাজার মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক ব্যবহারকারীকে বিচার-বহির্ভূতভাবে বিশেষ অভিযান চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।

তাঁর মেয়ে বংবং এর সঙ্গে একযোগে কাজ করে দেশকে 'ঐক্যবদ্ধ' করার অঙ্গীকার করেছেন, যাতে ফিলিপিন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে'।

তিনি ফিলিপিনে ১৮ বছর বয়সীদের জন্য সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করতে চান। আর বংবং অঙ্গীকার করছেন, যেসব অপরাধীকে সমাজে পুনর্বাসন করা যাবে না, তিনি তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করতে চান।

ম্যানিলায় মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো ২০০৯ সালের এক কূটনৈতিক বার্তা উইকিলিকস ফাঁস করেছিল। এতে মিজ দুতার্তেকে বর্ণনা করা হয়েছে "তার বাবার মতোই একজন কঠোর ধরণের মানুষ, যার সঙ্গে কথাবার্তা চালানো কঠিন।"

দুই হাজার এগার সালে তিনি এমন এক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, যেটি তার পরবর্তী জীবনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ফেলেছে। তখন মেয়র হিসেবে তিনি এক শেরিফের মুখে উপর্যুপরি ঘুষি মেরেছিলেন, কারণ ঐ শেরিফ একটি বস্তি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তার নির্দেশ অমান্য করেছিল।

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব

বংবং মার্কোস কিভাবে ফিলিপিনের রাজনীতিতে এরকম শক্তিশালী ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন, সেটা বুঝতে ইলোকোস নর্তে প্রদেশ থেকে বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। এই অঞ্চলটি মার্কোস পরিবারে শক্ত ঘাঁটি।

এ প্রদেশের বহু মানুষ এখনো মার্কোস পরিবারের প্রতি অনুগত, কারণ মার্কোস যখন ১৯৭২ সাল হতে ফিলিপিনের অন্যান্য জায়গায় তার নিষ্ঠুর সামরিক শাসন চালাচ্ছেন, তখন এই অঞ্চলের জন্য ছিল তার আলাদা দৃষ্টি, উন্নয়ন তহবিলের জন্য এই অঞ্চল সবসময় অগ্রাধিকার পেত।

"মনে করুন সারা দেশ এক ভয়ংকর টাইফুনে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ইলোকস নর্তে একেবারে অক্ষত, এখানে একটা আঁচড়ও পড়ছে না", বলছিলেন একজন সাংবাদিক।

এখানকার লোকজন বিশ্বাসই করতে চায় না যে মার্কোস পরিবার দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দোষী। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা রকম প্রচারণা চালিয়ে তাদের এই বিশ্বাস আরও দৃঢ় করা হয়েছে।

"সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা আলোচনাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যায়। কোন মানুষ দুর্নীতিবাজ কিনা, সেটা তাদের কাছে ব্যাপার না, তারা বলবে, এখানে তারা তো অবকাঠামোর অনেক উন্নতি করেছে, অনেক কাজ করেছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি। এদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হওয়ার মানে নেই," বলছেন একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী সা সা রিভাল। এই নারী হচ্ছেন এখানকার সেই ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু ভোটারদের একজন যিনি বংবং মার্কোসকে ভোট দেবেন না।

"হায় ঈশ্বর, কি বলবো, অনলাইনে এরা সারাক্ষণ আমার পেছনে লাগে, আমাকে হয়রানি করে। তারা জিজ্ঞেস করে, কেন আমি একজন ইলোকানো হয়েও মার্কোসের বিপক্ষে। কেন আমি অন্য কাউকে ভোট দেব। আমার উত্তরটা সহজ। কারণ, আমি একজন ফিলিপিনা," বলছেন এই নারী।

যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা নামের যে রাজনৈতিক কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, ব্রিটানি কাইজার তার একজন সাবেক কর্মকর্তা। তিনি ফিলিপিনের নিউজ ওয়েবসাইট র‍্যাপলারকে জানিয়েছেন, বংবং একবার কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার দ্বারস্থ হয়েছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের পরিবারের ভাবমূর্তির 'রিব্রান্ডিং' করার জন্য। তবে বংবং মার্কোসের শিবির একথা অস্বীকার করছে।

তবে এটা যে কেবল অতীতের ইতিহাস বিকৃত করার মতো ব্যাপার, তা নয়। এক্ষেত্রে আরও কিছু কৌশলও নেয়া হয়েছে।

যেমন যেসব সাংবাদিক বা ব্যক্তি সত্য তুলে ধরছে, তাদেরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া একাউন্ট থেকে তীব্রভাবে আক্রমণ করা হয়, এখানে জবাবদিহিতার কোন বালাই নেই।

যেমন, মার্কিন সাংবাদিক জিম লরি হয়তো মার্কোসের সামরিক শাসনামলে তার প্রত্যক্ষ রিপোর্টিং এর অভিজ্ঞতা দিয়ে কোন ভিডিও ইউটিউবে ছাড়লেন। তখন ডজন ডজন ভুয়া একাউন্ট থেকে তার কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে।

"ওরা এরকম সব কথা বলবে: 'আমি এটা বিশ্বাস করি না, ১৯৮৬ সালের এই ভিডিও আসলে ভুয়া, এটা সত্য হতে পারে না" বলছেন মিস্টার লরি।

"এরকম একটা বিভাজিত মতামত এখানে তুলে ধরা হচ্ছে, এটা আসলে এখন একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা.. এটা করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এর ফলে ইতিহাস এবং ঘটনাপঞ্জী মারাত্মকভাবে বিকৃত হচ্ছে", বলছেন জিম লরি।

বিবিসি ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এ নিয়ে কথা বলতে, কিন্তু তারা এ নিয়ে একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, "২০১৭ সাল হতে এ পর্যন্ত ফেসবুকের নিরাপত্তা টিমগুলো ফিলিপিনে প্রভাব বিস্তারের জন্য চালানো ১৫০টি ছদ্ম অভিযান বন্ধ করে দিয়েছে, যেগুলো ফেসবুকের নীতির পরিপন্থী।"

কোম্পানিটি আরও জানিয়েছে, "তারা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ ও ভুল তথ্য ছড়ানো বন্ধ করা এবং রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সিভিল সোসাইটি, নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সবার সঙ্গে মিলে কাজ করছে।"

গত জানুয়ারিতে টুইটার বংবং মার্কোসের সমর্থকদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে কথিত শত শত একাউন্ট বন্ধ করে দেয়, কারণ এগুলোর বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গ করার অভিযোগ উঠেছিল।

তবে বলা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো আসলে যথেষ্ট করছে না। ফিলিপিনে এই সমস্যাটা বেশি প্রকট, কারণ সেখানে লোকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে অনেক বেশি।

জার্মান ডেটাবেজ কোম্পানি স্ট্যাটিস্টার সমীক্ষা অনুসারে, ফিলিপিনের ১৬ হতে ৬৪ বছর বয়সী একজন মানুষ গড়ে প্রতিদিন চার ঘণ্টা সময় কাটান সোশ্যাল মিডিয়ায়। যুক্তরাজ্যে একজন মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় কাটান দু ঘণ্টা সময়।

বংবং এর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের ম্যানেজার ভিক রড্রিগুয়েজ বলেছেন, তারা তাদের মতো করে জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে যাবেন।

ফিলিপিনে স্বাধীন গণমাধ্যমকে তারা 'মার্কোস পরিবারের বিপক্ষে' বলে গণ্য করেন। তারা এসব গণমাধ্যমে কোন সাক্ষাৎকার দেন না। বিবিসি একটি সাক্ষাৎকারের অনুরোধ জানিয়েছিল, কিন্তু কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও বংবং এর শিবির বিরাট বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ জনসভার আয়োজন করে। তবে সেখানে বংবং মার্কোসকে ঘিরে রাখেন লাল শার্ট পরা শত শত সমর্থক, যাতে রিপোর্টাররা তার ধারে কাছে ঘেঁষতে না পারেন, তাকে কোন প্রশ্ন করতে না পারেন।

যারা এসব জনসভায় যোগ দেন, তাদের মধ্যে বিনামূল্য বিতরণ করা হয় রিস্টব্যান্ড, টি শার্ট বা কফির প্যাকেট। এসবের গায়ে বংবং মার্কোসের হাস্যোজ্জ্বল ছবি সাঁটা।

জনতাকে সেখানে পপ মিউজিক, কমেডি আর নাচ দিয়ে উজ্জীবিত করা হয়। এরপর মার্কোস সমর্থক রাজনীতিকরা এসে একের পর এক বক্তৃতা দেন। বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের নীতি কী হবে, সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা অবশ্য খুব কমই দেখা যায়।

গত এপ্রিলে বিবিসি বংবং মার্কোসের এরকম একটি জনসভায় গিয়েছিল, সেখানে তিনি এসেছিলেন ঝকঝকে টয়োটা এসইউভি গাড়ির এক বিশাল বহর নিয়ে। যখন তিনি তার সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, আমরা তার দিকে এগিয়ে যাই এবং জিজ্ঞেস করি, তিনি যদি একটি সিরিয়াস সাক্ষাৎকার দিতে রাজী না হন, তাহলে কীভাবে তিনি একজন ভালো প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন?

তিনি প্রশ্ন শুনে হাসলেন, তবে কোন জবাব দিলেন না।

তবে বংবং মার্কোসের সমর্থকরা এরকম প্রশ্ন করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের সমালোচনা করলেন, বললেন, আমাদের প্রশ্নের ধরণ ছিল বেশ অভদ্র এবং সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার। তাদের মতে, স্বাধীন গণমাধ্যম মার্কোস পরিবারের প্রতি অন্যায্য আচরণ করেছে। অনেকে স্বীকার করছেন যে মার্কোস পরিবার দুর্নীতি করেছে, তবে তারা খ্রিস্টধর্মের অনুশাসন অনুযায়ী এসব ক্ষমা করে তাদের দ্বিতীয়বার সুযোগ দেয়ার পক্ষে।

তবে মার্কোস পরিবারের সমালোচকরা বলছেন, বংবং যেভাবে তার নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন, তাতেই তার অসততার পরিচয় মেলে। তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হতে চান না, তিনি সারাক্ষণ তার বশংবদ লোকজন, যারা সারাক্ষণ তার কথা হ্যাঁ বলবে, তাদের দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখেন।

তারা আশংকা করছেন, বংবং মার্কোস ফিলিপিনকে সেখানেই নিয়ে যাবেন, ১৯৮৬ সালে তাঁর বাবা দেশটিকে যেখানে রেখে গিয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র বিবিসি

আইনিউজ/এমজিএম

 

আইনিউজ ভিডিও

কারুকার্যখচিত ঈদগাহের আলোকসজ্জা

ব্রাহ্মণবাজার : হাজারো মহিষ ওঠে এই বাজারে

Green Tea
সর্বশেষ