শ্যামলাল গোঁসাই
কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
বাঙলা ভাষার প্রথম বইটির নাম কী? এই প্রশ্নের উত্তরে শুনে বিদ্বান যারা তারা হয়তো বলবেন ‘চর্যাপদ’। কিন্তু যাদের বাঙলা ভাষার ইতিহাসে অলিগলি ঘুরা আছে তারা অকপটে যে বইটির নাম বলবেন সেটি ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’। বাঙলা ভাষার প্রথম বই ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ।‘ বইটি ১৭৪৩ সালে রোমান হরফে লেখা হয়েছিলো। প্রকাশ হয়েছিলো পর্তুগালের লিসবনে।
বাঙলা ভাষার প্রথম বই, অথচ নেই বাঙলা অক্ষর প্রকাশেও নেই বাঙলাদেশের জায়গা! এই বিষয়টি অনেকের কাছেই বিষ্ময়ের ঠেকে। এবং যেকারণে অনেকেই ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’কে বাঙলা ভাষার প্রথম বই বলে মেনে নিতে পারেন না।
চর্যাপদকে যারা বাঙলা ভাষার প্রথম বই মনে করেন তাদেরকে মনে করিয়ে দেয়া দরকার চর্যাপদ বাঙলা অক্ষর ব্যবহার করে লেখা হয়নি, আর বইটি উদ্ধার করা হয়েছিলো নেপাল থেকে। ‘কৃপার শাস্ত্রের ভেদ’ বইটিও তেমনি। চর্যাপদের সাথে এটির পার্থক্য হলো- এর লিখিত রূপ রোমান অক্ষরে হলেও উচ্চারিত রূপ ছিলো বাঙলা।
পর্তুগীজরাই সর্বপ্রথম এদেশে (ভারতবর্ষ) ছাপাখানা নিয়ে আসে
অন্যদিকে চর্যাপদের লিখিত এবং উচ্চারণ রূপ কোনোটিই বাঙলায় ছিলো না। কিন্তু বাঙলা ভাষার সাথে ছিলো চর্যাপদের গভীর সম্পর্ক। এই গভীর সম্পর্ক সত্ত্বেও বাঙলা ভাষায় তখনো অক্ষরের জন্ম হয়নি। পর্তুগিজরা যখন এদেশে আসে তখনো আমরা ছিলাম সমৃদ্ধ বর্ণমালা-ব্যকরণবিহীন এক জাতি। আমাদের না ছিলো সুনির্দিষ্ট বর্ণ না ছিলো সুনির্দিষ্ট ভাষা। বলতে হবে পর্তুগিজরাই আমাদের ভাষার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখেছে অসীম।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইউরোপীয়দের মধ্যে পর্তুগীজদের আগমনই সর্বপ্রথম ঘটেছিলো, সম্ভবত ১৪৯৮ সালের মাঝামাঝিতে। সেই থেকেই ভারতীয় সভ্যতা কিংবা আমাদের বাংলায় ব্যাপকভাবে বিদেশীদের সংমিশ্রণ ঘটা শুরু করলো, সেই সাথে জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটলো। ধারণা করা হয়, আমরা যে আমাদের খাবারে মরিচের ব্যবহার করি সেটাও নাকি এসেছিলো নাকি এই পর্তুগীজদের থেকেই। অনেকে আবার মনে করেন শুক- হুন, মোগল- পাঠানরা ভারতবর্ষে এসে রাজত্ব করলেও আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে পারেনি, এর সূত্রপাতও নাকিব হয়েছিল পর্তুগীজদের হাত ধরেই। সে যাই হোক কেনো, এ জাতি দ্বারা আমাদের সবচেয়ে যে দিকটি বেশি প্রভাবিত হয়েছে তা হলো ভাষা ও সংস্কৃতি।
এই পর্তুগীজরাই সর্বপ্রথম ছাপাখানা নিয়ে আসে। ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা এখানকার স্থানীয় মানুষের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন, অনেকে আবার স্থায়ীভাবে বসতি শুরু করেন। ফলে বিনিময় ঘটেছিলো একে- অন্যের ভাষার। ব্যবসা- বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য দেশীয়রা যেমন ভাঙা ভাঙা পর্তুগীজ শিখেছিলেন, তেমনি পর্তুগীজরাও শিখেছিলো আধো বাংলা। বাংলা ভাষার অনেক শব্দ যেমন তারা গ্রহণ করা শুরু করেন, তেমনি তাদেরও অনেক শব্দ মিশে যায় আমাদের ভাষার সাথে।
'চর্যাপদ' এর লিখিতরূপ
জনশ্রুতি আছে, একবার পর্তুগীজ দস্যুরা এক বাঙালী রাজপুত্রকে অপহরণ করে একটি খ্রিস্টান মিশনারীর কাছে বিক্রি করে দেয়। এই রাজপুত্রের নাম ছিলো দোম অন্তোনিয়া। তিনি খ্রিস্টধর্মের প্রচারের জন্য ব্রাহ্মণ- রোমান- ক্যাথলিক সংবাদ নামে একটি বই লেখেন; যদিও এটি প্রকাশিত হয়নি। তাই বাংলা ভাষার প্রথম বই হিসেবে এটি স্বীকৃতি পায়নি।
বাংলা ভাষায় প্রথম যে বইটি ছাপা হয় তা হলো “কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ”। পর্তুগীজ লেখক ম্যানোয়েল দা আসসুমসাঁও এই বইটি লেখেন। অনেকের মতে, একজন অনুলেখক এর মাধ্যমে তিনি এই বইটি লিখিয়ে নেন। বইটি লেখা হয় রোমান হরফে। ঠিক কবে বইটি লেখা হয়েছিল তা সঠিক ভাবে জানা যায় নি, তবে ধারানা করা হয় সম্ভবত ১৭৩৩ সালে বইটি লেখা শেষ হয়। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় ১৭৪৩ সালে লিসবনে।
'কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ' বইটির ছাপাকৃত একটি ছবি
মূলত খ্রিস্টধর্মের প্রচারের জন্য এই বইটি লেখা হয়েছিল। কিন্তু অনেকের মতে বই এর মূল বিষয়বস্তুর খ্রিস্টধর্মের খুব একটা মিল পাওয়া যায় না তাই অনেকে এটিকে খ্রিস্টধর্মের বই হিসেবে মানতে নারাজ।
বিভিন্ন মতবাদ থেকে জানা যায় এই বই এর উচ্চারণ ছিল প্রাচীন সংস্কৃত বাংলা। অনেকে আবার বলেন এটি পর্তুগীজদের মুখের বাংলা উচ্চারণের মতো করে লেখা হয়েছিল।
‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ বইটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। যদিও এটি বাঙলা অক্ষরে লিখা হয়নি। তবু এটি বাঙলা ভাষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।
পর্তুগীজরা একটি সমৃদ্ধ বাংলা বর্ণমালা ও ব্যাকরণ তৈরিতেও বেশ ভূমিকা রেখেছিল। আর এই বইটির পরেই বাংলা বর্ণমালায় বাংলা বই প্রকাশের জন্য নানা উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এটি ছিলো বাংলা ভাষায় প্রথম কোনো মুদ্রিত বই।
বাংলা ভাষার এ প্রথম বইটি ছাপা হয়েছিলো ইউরোপে যা অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা