নাসির উদ্দিন
আপডেট: ১৮:৫৮, ১ অক্টোবর ২০২১
বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
স্কুল চলাকালীন সময় চৌদ্দ (১৪) বছরের নিচে কোন শিশুকে তার পরিবারের লিখিত অনুমতি ছাড়া উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ দেয়া বা কাজ করিয়ে নেয়াকে শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে শিশুশ্রম একটি সামাজিক ব্যাধি। আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, সম্পদের অসম বন্টন, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে ফুলের মতো কোমল নিষ্পাপ শিশুদের কচি কচি হাতগুলো শ্রমের হাতিয়ার হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। ফলে তাদের সুপ্ত প্রতিভা অংকুরেই বিনষ্ট হয়।
ছোট খাট কল-কারখানা থেকে শুরু করে পাথর ভাঙ্গা, ফেরি করা, ভিক্ষাবৃত্তি করা, বাসা বাড়িতে কাজ করা, গার্মেন্টস, গ্যারেজ, দোকান পাট, হোটেল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যেসব কাজ ঝুকিপূর্ণ সেসব কাজে অবলীলায় শিশুদের নিয়োগ করা হয়।
ময়মনসিংহের মেয়ে শেফালী, বয়স ১২ বছর। অভাবের সংসারে খাদ্যাভাবে খালার সাথে ঢাকায় আসে। খালা একটা বাসায় কাজ জুটে দেয়। কিন্তু গৃহকর্তার দুর্ব্যবহারের কারণে সেখানে আর বেশি দিন কাজ করা হয় নি। অনেকটা বাধ্য হয়েই পেটের দায়ে পাথর ভাঙ্গার কাজে নেমে পড়ে। যে বয়সে তার হেসে খেলে পড়াশোনায় মত্ত থাকার কথা সে বয়সে সে হাড়ভাংগা খাটুনি করছে পেটের দায়ে।
দরিদ্র দেশগুলোতে শিশুশ্রম চালু হওয়ার প্রধান কারণ দুটি। পেটের তাগিদে তাদের কোথাও কাজ করতে হয় অথবা শ্রমের বিনিময়ে তারা অন্নের সংস্থান করে। অন্যদিকে, শিশু শ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে অনেক কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। এ জন্য নিয়োগকারীরা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগায় এবং বেশি করে খাটায়। বাল্য বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ।
শৈশবকালে শিক্ষার আলো আহরণের বদলে কঠিন শ্রমে জড়িয়ে থাকা এসব শিশুর বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশ হয় না। শিক্ষার আলো বিবর্জিত পরিবেশে এরা অশিক্ষিত গোঁড়া ও দুশ্চরিত্র হিসেবে বেড়ে ওঠে। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় সন্ত্রাস, চুরি ডাকাতির মতো নৃশংস ঘটনার সূত্রপাত এবং অশিক্ষিত এ সমস্ত মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও শিক্ষার দিকে ধাবিত করে না।
বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৫-১৪ বছর বয়সী মোট শিশু জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ, ছেলে শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ২১.৯ শতাংশ এবং মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে তা ১৬.১ শতাংশ । অর্থনীতির খাত অনুযায়ী শিশু শ্রমিকদের বণ্টনের চিত্র হচ্ছে: কৃষি ৩৫ শতাংশ, শিল্প ৮ শতাংশ, পরিবহন ২ শতাংশ, অন্যান্য সেবা ১০ শতাংশ এবং গার্হস্থ্যকর্ম ১৫ শতাংশ । কিন্তু পরিবহন খাতে শিশুশ্রমের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য ব্যাপক। অর্থাৎ যেখানে ০.১ শতাংশ মেয়ে শ্রমিক সেখানে ছেলে শ্রমিক হলো ৩ শতাংশ । তবে শিশুশ্রম নিয়োগের প্রায় ৯৫ শতাংশ -ই ঘটে অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদের জন্য সাপ্তাহিক গড় কর্মঘণ্টা আনুমানিক ৪৫ এবং মাসিক বেতন ৫০০ টাকার নিচে। মেয়ে শিশু শ্রমিকের মাসিক বেতন ছেলে শিশুশ্রমিকের তুলনায় গড়ে প্রায় ১০০ টাকা কম। বাংলাদেশের আনুমানিক ২০ শতাংশ পরিবারে ৫-১৪ বছরের কর্মজীবী শিশু রয়েছে। এই সংখ্যা শহুরে পরিবারগুলির জন্য ১৭ শতাংশ এবং গ্রামীণ পরিবারের জন্য ২৩ শতাংশ ।
শিশুশ্রম এমন এক সমস্যা যার চটজলদি সমাধান আইন করেও সম্ভব নয়। সরকার তথা রাষ্ট্রনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে কিছুই করছেন না, তা কিন্তু নয়। শিশুশ্রম নিয়ে রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনারও এক ক্রমান্বয়িক ইতিহাস আছে বৈকি! আছে আইন এবং আইন তৈরির উপাখ্যান। আমাদের পেনাল কোডে বিভিন্ন ধারায় শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা আছে। সগর্বে কাগজের পৃষ্ঠায় আছে মতো শ্রম আইন, ন্যূনতম মজুরি আইন। এইসব আইন কার্যকর হলেই তো শিশুশ্রম প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যেত। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটা তো আমরা সবাই দেখছি। শিশুশ্রম প্রথা রুখবার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন-আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আই এলও) ‘ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত আইন’ এর ১৩৮ নম্বর ধারা। চালু আছে শিশুশ্রম নিরোধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কর্মসূচি (International Programme on the Elimination of Child labour IPEC) বা আইপিসি-যার উদ্দেশ্য শিক্ষার প্রসার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রথা বিলোপ করা। রয়েছে শিশুর অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের আইন (Convention on the Rights on the Child) আছে আইএলও পরিচালিত চাইল্ড লেবার অ্যাকশন সাপোর্ট প্রোজেক্ট (CLASP)। এর উদ্দেশ্য হলো দেশে দেশে জাতীয় সরকারগুলোর পরিকল্পনা গ্রহণ ও রূপায়নের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলা। সারা পৃথিবীর এইসব অবহেলিত নিপীড়িত শিশুদের সমস্যা নিয়ে ১৯৯০ সালে যে বিশ্ব শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় থাকে শিশুদের অস্তিত্ব, নিরাপদ ও বিকাশের জন্য একটি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। শিশুশ্রমদের ইতিহাসে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশকে আহ্বান জানানো হয়। বিপজ্জনক কাজে নিযুক্ত ও শোষিত শিশুদের সুস্থ ও উন্নত জীবন যাপনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য একটি কর্ম পরিকল্পনাও নেওয়া হয় এখান থেকে। এরপর ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ ও অন্যান্য বিকাশশীল দেশগুলোর শ্রম মন্ত্রীদের এক বিশ্ব সম্মেলনে শিশু শ্রমকে একটি ‘চরম নৈতিক অপরাধ’ এবং মানবিকতা ও আত্মমর্যাদার প্রতি অত্যন্ত অবমাননাকর বলে বর্ণনা করা হয়। এই সম্মেলনেও শিশুশ্রম নির্মূল করার জন্য কর্ম পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরের বছর ১৯৯৬ সালে জোট নিরপেক্ষ ও সার্ক সদস্যভূক্ত দেশগুলোর দুটি পৃথক বৈঠকে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমটিতে বিপজ্জনক কাজে শিশু শ্রমিক বন্ধ ও দ্বিতীয়টিতে ২০১০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে শিশুশ্রম নির্মূল করার কথা ঘোষণা করা হয়।
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। কেউ যদি শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোররা হালকা কাজ করতে পারবে। আগে ১২ বছরের শিশুরা হালকা কাজের এ সুযোগ পেত।
শিশুশ্রম বন্ধে প্রতিটি জেলা পর্যায় ১৪ বছরের কম শিশুদের সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করতে হবে। শ্রমজীবী প্রতিটি শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিশু শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতিত হয়ে থাকে, এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিশু শ্রম ও অধিকার সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
শিশুশ্রম বন্ধে সরকারও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো-শিশুর জন্য শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করা। মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা প্রবর্তন করা। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ও বিনামূল্যে শিক্ষা সামগ্রী প্রদান করা এবংউপবৃত্তি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।শিশুশ্রম বন্ধে মিডডে মিল চালু বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। প্রাথমিকে মিডডে মিল চালুর ফলে শিশুদের স্কুলে ফেরার প্রবণতা বেড়েছে।
বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে। তারা স্বেচ্ছাশ্রমে এবং নিজ খরচে পথশিশুদের নিয়ে নৈশ শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও অর্থনৈতিকভাবে শিশুশিক্ষা বিকাশে সাহায্য করছে।
প্রতি বছর ১২ জুন ‘শিশু শ্রম প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের আহ্বান, শিশু শ্রমের অবসান’। প্রতিবারের মতো বাংলাদেশ গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি এবারও পালন করছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে জাতিসংঘ ২০২১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক শিশু শ্রম নিরসন বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে। আইএলও ১৯৯২ সালে প্রথম শিশু শ্রমের জন্য প্রতিরোধ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে আইএলও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবছর ‘শিশু শ্রম প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে দিনটি পালন করে আসছে।
শিশুই জাতির ভবিষ্যৎ। শিশুদের মধ্যে সুপ্ত থাকে নানবিধ অমিত শক্তি ও সম্ভাবনা। আজকের শিশুই আগামী দিনের কবি সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশ ও জাতিকে গড়ে তুলবে। অথচ সেই শিশুই বিদ্যা অর্জনের পরিবর্তে অমানুষিক শ্রমে নিয়োজিত। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই শিশু অধিকার একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচিত। জাতিসংঘ সনদে শিশু অধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও এই সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। তাই এদেশে শিশুদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মূলধারায় ফিরিয়ে এনে সুশিক্ষা প্রদান করতে হবে। তবেই আজকের শিশুরা আগামী দিনের দেশ ও জাতির নেতৃত্বদানে যোগ্য হবে এবং দেশের অগ্রগতিতে মূল ভুমিকা পালন করবে।
নাসির উদ্দিন, সহকারি তথ্য কর্মকর্তা, তথ্য অধিদপ্তর।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ