Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ১০ আগস্ট ২০২৫,   শ্রাবণ ২৬ ১৪৩২

শামীমা এম রিতু

প্রকাশিত: ০২:২৯, ৮ জুলাই ২০২০

এন্ড্রু কিশোর : সুরের এক মায়াজাল

"এন্ড্রু কিশোর" এই নামটির সাথে আর কোন বিশেষ বিশেষণের দরকার পড়েনা। এই নামটিই বাংলা ভাষাভাষীদের বিশাল ভালবাসার প্রকাশ, ভালো লাগার প্রকাশ। ৬ জুলাই চলে গেলেন বাংলা গানের এই প্লে-ব্যাক সম্রাট। তাঁর কর্মকে স্মরণ করেই আজকের এই লেখা।

ছোটবেলায় যখন আমরা প্রতি শুক্রবার বিটিভিতে সিনেমা দেখার অপেক্ষা করতাম, তখন সাথে আরেকটি  উদ্দীপনা কাজ করতো সেটা হলো ছবিতে এন্ড্রু কিশোরের গান থাকবে। বড়রা কোন দরকারে টিভির সামনে থেকে গেলে বলতেন "ছবির গান এলে ডাক দিস, এন্ড্রু কিশোরের গান, মনে করে ডাক দিবি"। 

বাংলা প্লে-ব্যাকের এই প্রবাদপুরুষ শিল্পীর জন্ম ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর, বাংলা লোকগানের, সাহিত্য সংস্কৃতির অপার ভান্ডার রাজশাহীতে। রাজশাহীর ভাওয়াইয়ার মুগ্ধতায় ঘেরা পরিবেশে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক এবং স্ত্রী লিপিকাসহ ছিল তাঁর সাজানো সংসার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশোনা করলেও গান ছিলো তাঁর ধ্যান, সাধনা। তিনি আব্দুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে  গানের পাঠ শুরু করেন এবং নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং লোক ও দেশাত্মবোধক গানে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত হন। 

১৯৭৭ সালে বিখ্যাত সুরকার আলম খানের সুরে মেইল ট্রেন ছবির "অচীন পুরের রাজকুমারী নেইযে তার কেউ" গানের মধ্য দিয়ে প্লে-ব্যাক শুরু করেন। প্লে-ব্যাকে তার দ্বিতীয় গান ছিল বাদল রহমানের বিখ্যাত শিশুতোষ ছায়াছবি "এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী'র 'ধুম ধাড়াক্কা'। বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ব্যবসাসফল ছায়াছবি 'বেদের মেয়ে জোছনা'র বিখ্যাত গান - "বেদের মেয়ে জোছনা অামায় কথা দিয়েছে" - নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের লিপসিং এ গানটি গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। 

১৯৮২ সালে 'বড় ভাল লোক ছিল' ছবির "হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস' গানের জন্য প্রথমবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেন। এ গানের লিপসিংএ ছিলেন কিংবদন্তী অভিনেতা, বাংলা চলচ্চিত্রের মুকটহীন নবাব 'আনোয়ার হোসেন'। পরবর্তীতে তিনি আরো  সাতবারসহ মোট আটবার শ্রেষ্ঠ শিল্পী (পুরুষ) হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।

জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প, আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বুকের মধ্যখানে, আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, সবাইতো ভালবাসা চায় প্রভৃতি গান অপার মুগ্ধতা জাগায় মানুষের হৃদয়ে। তাঁর কণ্ঠেই রচিত হয়েছিল বাংলা প্লেব্যাক গানের তাজমহল- প্রেমের তাজমহল ছবিতে তিনিই সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে দর্শক-শ্রোতা মুগ্ধ করেছিলেন- প্রেমের তাজমহল গানের মাধ্যমে। সবাইতো ভালবাসা চায়, পৃথিবীর যত সুখ, আমি একদিন তোমায় না দেখিলে, তুমি আমার জীবন, দুঃখ বিনা হয়না সাধনা,ভালবাসিয়া গেলাম ফাসিয়া, এখানে আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো' - বিখ্যাত নায়ক প্রয়াত সালমান শাহের লিপসিংএ গেয়েছিলেন তিনি। সালমান শাহের বিখ্যাত 'আনন্দ অশ্রু' ছবিতেও "তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা' তার কণ্ঠেই কোটি দর্শক-শ্রুতার হৃদয়ে দোলা লাগিয়েছিলো।তুমি চাঁদের জোছনা নও, আকাশেতে লক্ষ তারা, চোখ যে মনের কথা বলে,এক টাকার বৌ ছবিতে প্রয়াত নায়করাজ রাজ্জাকের লিপসিং এ "ও লিটল ফ্রেন্ড, যদি বউ সাঁজো গো সহ ,এক বিন্দু ভালবাসা দাও প্রভৃতি জনপ্রিয় কালজয়ী গান তিনি উপহার দিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রে। অনেক নারী শিল্পীর সাথে প্লে-ব্যাকে গান করলেও  বাংলা চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছিলেন এন্ড্রু কিশোর-সাবিনা ইয়াসমিন জুটি। 

একক ভাবে সব থেকে বেশি গান পরিবেশন করেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান  হানিফ সংকেতের "ইত্যাদি" তে ,যার মধ্যে  জনপ্রিয় "পদ্ম পাতার পানি নয়"। গানে অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আটবার, বাচসাস পুরস্কার পাঁচবার এবং দুইবার লাভ করেন মেরিল- প্রথম আলো পুরস্কার। 

এন্ড্রু কিশোর তাঁর শুধু কণ্ঠে নয়, মাধুর্যভরা ব্যবহারে জয় করেছিলেন সকলের হৃদয়।বিতর্কহীন এই নক্ষত্র দীর্ঘ নয়মাস মরণ ব্যাধি ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে দয়ালের ডাকে রঙিন ফানুস হয়ে ৬৪ বছর বয়সে উড়ে গেলেও চিরকাল অমর থাকবেন বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় কোটি কোটি বাঙালি -বাংলা ভাষাভাষীদের হৃদয়ে। বিধাতা প্রদত্ত এই স্বর্গীয় কণ্ঠের সুরেলা পাখি বাংলা চলচ্চিত্রে  আশির দশক থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রায় দুইশতেরো অধিক চলচ্চিত্রে অসংখ্য গানে প্লে-ব্যাক করেছেন। তাঁর মৃত্যু বাংলা চলচ্চিত্রের কত বড় ক্ষতি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।খুব কম শিল্পী আছেন যারা বিতর্কহীন আপামর দর্শক শ্রোতাকে এভাবে সুরের মোহনীয় মায়াজালে আবদ্ধ রাখতে পারেন।

এন্ড্রু কিশোর প্রকৃতির নিয়মে চলে গেলেও তিনি বাংলা গানে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর গানে ,তার কর্মে। 

আইনিউজ/ এইচকে

Green Tea
বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ