আইনিউজ ডেস্ক
আপডেট: ১৬:৫৭, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০
আজ কালিকাপ্রসাদের ৫০তম জন্মদিন

আজ ১১ সেপ্টেম্বর। কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য-এর ভক্ত এবং দোহারের সদস্যদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বছরের এই বিশেষ দিনটা তাঁদের কাছে সেলিব্রেশনের, আনন্দের, হুল্লোড়ের। কারণ এ দিনই কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য-এর ৫০তম জন্মদিন। এ দিন কোনও মন খারাপ নয়। তাঁদের মন খারাপ হলে কালিকাদারও কষ্ট হবে যে...।
মাটির সুরে, একতারার বোলে মাতিয়ে রাখতেন প্রিয় কালিকাপ্রসাদ। লোকগানই নয়, ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতেও ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। লোকগানকে বাণিজ্যের মোড়কে বাঁধেননি কখনও। তাঁর গানে বরাবরই প্রাধান্য পেয়েছে লোকায়ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। তিনি কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য।
আধ্যাত্মিক দর্শনকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে পেরেছিলেন কালিকাপ্রসাদ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হওয়ার পরও গোঁড়া ধর্মীয় আর সামাজিক বেড়াজালকে ছিন্ন করা বাউলেরা যেভাবে গানে গানেই প্রচার করেছেন নিজেদের দর্শন, ঠিক একইভাবে একালের গণজাগরণের আন্দোলনেও নিজের হাতিয়ার হিসেবে গানকেই তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
২০১৭ সালের ৭ মার্চ, মাত্র ছেচল্লিশ বছর বয়সে হুগলির গুড়াপের কাছে পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান কালিকা ভট্টাচার্য। বীরভূমে একটি গানের অনুষ্ঠান সেরে জাতীয় সড়ক ২ ধরে ফিরছিলেন কালিকা ও তাঁর দল। তাঁর মৃত্যুতে শিল্পীমহল ও সঙ্গীতপ্রিয় মানুষের মধ্যে বিষাদের ছায়া নেমে আসে।
ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতে অসামান্য দখল ছিল তাঁর। দীর্ঘদিন নানা শিল্পীর সঙ্গে হারমোয়িয়ামে সঙ্গত করেছেন । তবলার তালিম নিয়েছেন পণ্ডিত অনিল ভট্টাচার্যর কাছে। গানের সঙ্গে বিভিন্ন যন্ত্রও বাজাতে পারতেন কালিকাপ্রসাদ। লোকগানকে বাণিজ্যের মোড়কে বাঁধেননি কোনওদিন। মাটির গান গেয়েছেন লোকায়ত যন্ত্র নিয়েই। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সিনেমার গানে সুর করছিলেন তিনি। লোকসঙ্গীতকে নতুন আঙ্গিকে মানুষের সামনে তুলে ধরার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থেকেছেন অধিকাংশ সময়। বাংলা বিনোদন চ্যানেলের অসম্ভব জনপ্রিয় রিয়ালিটি শোতে প্রতিযোগীদের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর হাত ধরে সঙ্গীতের আঙিনায় পা রেখেছেন অনেকে। পরম যত্নে তাঁদের মূল স্রোতে আনার কাজ করছিলেন কালিকাপ্রসাদ। শিল্পীর অকালমৃত্যুতে অভিভাবকহীন হলেন তাঁরা। শোকস্তব্ধ অসংখ্য গুণমুগ্ধ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শুনে বড় হওয়া। ছোট বেলা থেকেই মন ছুটত টুসু,ভাদু,ভাওয়াইয়ায়। ভাটিয়ালি সুরের উজান বাওয়া গান শুনতে শুনতে একসময় মনে হল জোট বাধা দরকার।
তিনি জন্মেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন পপ আর রকের দাপটে বাঙালির আটপৌরে আঞ্চলিক গানগুলো ডুবে যাচ্ছিল অবহেলার আঁধারে। তার একক প্রচেষ্টাতেই সেই অনাদর থেকে মূলধারায় স্রোতে ফেরে লোকগান।
গানের দল দোহার-এর কাণ্ডারি, কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য’র সুরের সুতোয় দুই বাংলাকে একত্রে গাঁথার প্রয়াস যখন সবে শুরু, ঠিক তখনই বর্ধমানের এক সড়ক দুর্ঘটনা থামিয়ে দিল সব।
আসামের শিলচরের ভট্টাচার্য পরিবারের সবাই ছিলেন কোনো না কোনোভাবে গানের সঙ্গে যুক্ত। তাই এই পরিবারের ছেলে গানকেই করবেন জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, এ ঘটনা বিস্ময় জাগায়নি কারো মনে। তবে বাবা রামচন্দ্র ভট্টাচার্য’র দেখানো ধ্রুপদী সংগীতচর্চার পথে না এগিয়ে কালিকা ঝুঁকেছিলেন কাকার লোকগানের আধ্যাত্মিক দর্শনেই।
কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য’র সংগ্রহে ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি লোকগান। সেসব শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন কালিকা। আর সেইসব গানকে অবলম্বন করেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন গানের দল দোহার।
নতুন সহস্রাব্দের সূচনা লগ্নে সবাই যখন ঝুঁকছে পশ্চিমা সুর-লয়ের দিকে, ছাত্রদের ব্যান্ড মানেই যেখানে সফট, অল্টারনেটিভ থেকে শুরু করে হার্ড ও প্রগ্রেসিভ রক ঘরানার গান, সেখানে দোহার যেন ছিল এক ব্যতিক্রমী নাম। নিজেদের মৌলিক গান দিয়ে নয়, দোহার পরিচিত পেয়েছিল আবহমান বাংলার বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকার মতো ভুলতে বসা লোকগান নতুন করে তুলে এনে।
হার-এর দর্শন আর নিজের সংগীতচর্চার চিন্তাধারাকে তুলে ধরে কালিকাপ্রসাদ বলেছিলেন, “আমরা লোকগান গাই। নতুন গান লিখি না বা গাই না। আমাদের গানে পশ্চিমী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয় না। সেই জন্যই ‘দোহার’ গানের দল। ব্যান্ড নয়।’’
শুধু লোকগান গেয়েই তাদের একটা নিজস্ব শ্রোতা তৈরি হয়। চিরচেনা সুরগুলোকেই নিজস্ব আঙ্গিকে বাজানোর কায়দা, বিভিন্ন মেঠো বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢোল, খোল, মাদল, ধামসা, সারিন্দা, ডুবকি, খঞ্জনি বাজিয়ে গানের সঙ্গে ধ্বনির বাতাবরণ তৈরির ব্যাপারগুলোকেই দারুণভাবে গ্রহণ করে।
বাংলাদেশেও ঠিক সেই সময়টাতেই আর্টসেল, ব্ল্যাক, নেমেসিস, ক্রিপটিক ফেইট-এর মতো ব্যান্ডগুলোর পাশাপাশি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বাংলা কিংবা লালন-এর মতো ব্যান্ড। অর্ণবের গাওয়া ‘সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছি ঘর’ তখন তুমুল জনপ্রিয়। হাবিব-এর সংগীতায়োজনে শাহ আব্দুল করীম-এর গানগুলোও তখন ফিরছে নতুন প্রজন্মের মুখে মুখে।
এরমধ্যেই ২০০৭ সালের ‘মনপুরা’ দিয়ে ঘটে গেল বিপ্লব! অর্ণব, কৃষ্ণকলি, ফজলুর রহমান বাবুর কণ্ঠে ‘নিথুয়া পাথারে’, ‘সোনার পালঙ্কের ঘরে’, ‘আমার সোনার ময়না পাখি’র মতো গানগুলো পেল নতুন জীবন।
ওপারে যখন লোকগানকে জনপ্রিয় করে তুলছে দোহার, তখন এপারে এইসব গানের মূলধারায় ফিরে আসা- ঘটনাগুলোকে খুব বেশী কাকতালীয় বলা যায় কি?
কালিকাপ্রসাদ নিজেও কিন্তু লক্ষ্য করেছিলেন গানের জগতের এই হাওয়া বদল। তিনি বলেছিলেন, “আগে কখনও কলেজ সোশ্যালে লোকগীতি হত না। এখন হয়। কলেজের ছেলেরা যখন ব্যান্ড তৈরি করে অনুষ্ঠান করে দু’-তিনটে সাধারণ গান গাওয়ার পর চলে যায় লোকগানে। সিনেমাতেও আসছে লোকগান। লোকগান চলে এসেছে মেইনস্ট্রিম ইন্ডাস্ট্রিতে। এই ভাবেই লোকগান প্রসারিত হয়েছে।”
তবে লোকগানের এই বাণিজ্যিকীকরণ-এর মধ্যেও এর সারকথা, আধ্যাত্মিক দর্শনকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে পেরেছিলেন কালিকাপ্রসাদ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হওয়ার পরও গোঁড়া ধর্মীয় আর সামাজিক বেড়াজালকে ছিন্ন করা বাউলেরা যেভাবে গানে গানেই প্রচার করেছেন নিজেদের দর্শন, ঠিক একইভাবে একালের গণজাগরণের আন্দোলনেও নিজের হাতিয়ার হিসেবে গানকেই তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
২০১৩ সালে সেভাবেই তৈরি হয়েছিল ‘শাহবাগ দিচ্ছে ডাক’ গানটি। এ প্রসঙ্গে কালিকা বলেছিলেন, সাধারণত গান না লিখলেও ‘প্রাণের তাগিদে’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে তিনি লিখেছিলেন গানটি।
সিনেমাতে কালিকাপ্রসাদ-এর গাওয়া গান এর আগে ব্যবহার হয়েছে দুবার, সৃজিত মুখোপাধ্যায়-এর ‘জাতিস্মর’ আর গৌতম ঘোষ-এর ‘মনের মানুষ’-এ। তবে বাংলাদেশের প্রতি নিজের ‘প্রাণের তাগিদে’ই প্রথমবারের মতো সংগীত পরিচালনা করেন তিনি সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভুবন মাঝি’তে।
মুক্তিযুদ্ধ এবং সমকালীন সময়ের মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঘিরে তৈরি হওয়া সিনেমাটির প্রাণই ছিল কালিকাপ্রসাদ-এর সংগীত।
সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে মাত্র চারটি গান, যা মূলধারার বাংলা সিনেমার তুলনায় কমই বলা যেতে পারে। তবে এই ক’টি গান দিযেও সিনমাজুড়ে যে মায়াজাল তৈরি করেছেন কালিকাপ্রসাদ, তা এককথায় অনবদ্য।
‘আমি তোমারই নাম গাই’ গানটি ইউটিউবের সুবাদে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এরমধ্যেই; সহজ-সরল কথা আর একেবারেই আটপৌরে সুরের গানটি দিয়ে যেন চিরচেনা বাঙালির মধ্যবিত্ত প্রেমকে তুলে ধরেছেন কালিকাপ্রসাদ।
ওদিকে ‘ছিল ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা’ গানটিতে বারবার যুদ্ধের আঘাতে বাঙালির শেকড়ছিন্ন হয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার কষ্টই উঠে আসে গ্রামীন সুরের আবহে। গানটি ঘরের কাজ করতে করতে গুনগুন করে গেয়ে ওঠার গান, দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার কান্না লুকিযে প্রতিরোধের ডাক দেওয়ার গান।
আবার ‘বোতলে পুরেছি কান্না’ পুরোপুরি ভিন্ন মেজাজের গান; নাগরিক কপটতার কালে বিবেককে উজাড় করে নির্মোহ সত্যকে তুলে ধরার গান যেন এটি। অ্যাকুস্টিক গিটারের সুর আর শহুরে কথার গানটি অনায়সেই জ্বালাতে পারে বিদ্রোহের আগুন।
তবে কালিকাপ্রসাদ-এর নিজের মেজাজের সঙ্গে যে গানটি সবচেয়ে সঠিকভাবে যায়, সেটি হলো ‘পদ্মা নদীর নৌকা ভিড়েছে হুগলি নদীর তীরে’। সিনেমার অভিনেতা পরমব্রত-র কণ্ঠ দেওয়া গানটি কথায় কিংবা সুরে, সব দিক থেকেই যেন তুলে ধরে দোহার-এর দর্শনকে। লালনের গানের কথার সঙ্গে তো মিলে যাবেই এই গানের কথাগুলো, সেই সঙ্গে ভালোবাসার বাঁধনে দুই বাংলার মানুষকে একই সমতলে নিয়ে আসার স্বপ্নের কথা বলে গানটি, যে স্বপ্ন অনেকের মতোই কালিকাপ্রসাদ নিজেও প্রবলভাবে দেখেছেন।
তো সেই হুগলিরই হোক, আর পদ্মাপারেরই হোক- গণমানুষের গান একজীবনে যেভাবে তুলে এনেছেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, তাতে করে চিরস্মরণীয় হযেই তিনি রযে যাবেন দুই বাংলাতেই।
- নিউ জার্সির চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রীমঙ্গলের ২ নির্মাতার ৬টি চলচ্চিত্র
- ‘হাওয়া’ দেখতে দর্শকদের ভিড়, খোদ নায়িকা সিঁড়িতে বসে দেখলেন সিনেমা
- লুঙ্গি পরায় দেওয়া হয়নি সিনেপ্লেক্সের টিকেট, সেই বৃদ্ধকে খুঁজছেন নায়ক-নায়িকা
- সেরা পাঁচ হরর মুভি
- বিয়ে করেছেন মারজুক রাসেল!
- শোকের মাসে শ্রীমঙ্গলের স্কুলগুলোতে প্রদর্শিত হলো ‘মুজিব আমার পিতা’
- শাকিবের সঙ্গে বিয়ে-বাচ্চা তাড়াতাড়ি না হলেই ভাল হত: অপু বিশ্বাস
- গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর শোক
- নারী বিদ্বেষীদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নতুন যাত্রা শুরু : জয়া আহসান
- প্রিন্স মামুন এবং লায়লার বিচ্ছেদ