Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ০৩ মে ২০২৫,   বৈশাখ ১৯ ১৪৩২

অমলেন্দু কুমার দাশ

প্রকাশিত: ২০:৪৯, ১৬ অক্টোবর ২০২১
আপডেট: ২০:৫৮, ১৬ অক্টোবর ২০২১

বন্দী প্রত্যাবর্তন ও কিছু মানবিক উদ্যোগ (১ম পর্ব)

ভারত-বাংলাদেশ প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারত বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের একজন পরম মিত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সফল কূটনীতির মাধ্যমে ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন।

বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের আমলে এ কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর ও নিবিঢ় হয়েছে। অপরদিকে ভারতের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার বাংলাদেশের সাথে তদ্রুপ কূটনৈতিক সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। উভয় দেশের এ সুন্দর কূটনৈতিক সম্পর্কের কারণে পররাষ্ট্রনীতি সফল হচ্ছে।

প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের একদিকে ভারতের ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ অপরদিকে ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ৩০ টি জেলা। ভারত-পাকিস্তানের জন্মের সময় এই সীমান্তের সৃষ্টি হলেও সীমান্তের উভয় দিকে বসবাসরত দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে ভাষা,সংস্কৃতি, ঐতিহ্যগত কারণে রয়ে গেছে মধুর প্রতিবেশীর সম্পর্ক। কূটনৈতিক দিক থেকে নিজের দেশের সীমানায় থেকে মানবিক এ সম্পর্কে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট গ্রেফতার হয়ে কারাগারে স্থান হয়।

উভয় দেশের ছোটখাটো চোরাকারবারি, শ্রমিক, নারী ও শিশু, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির লোক দালালদের খপ্পরে পরে কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে অবৈধভাবে উভয় দেশেই অনুপ্রবেশ করে থাকে। মানসিক ভারসাম্যহীন ও ভবঘুরে ব্যক্তিরা অনেক সময় না বুঝে সীমান্ত অতিক্রম করে ফেলে। অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে তারা সে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বন্দী হয়। আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার কাজ ও সাজা ভোগ শেষে তারা নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উভয় দেশের বিদ্যমান প্রশাসনিক জটিলতা, বন্দীদের তথ্যগত ভুল ঠিকানা ও ভাষাগত সমস্যার কারণে এই প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়ে বন্দীরা নির্ধারিত সাজা ভোগ শেষ হওয়ার পরও মানবেতর বন্দী জীবনযাপন করতে থাকেন।

বন্দী প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের একটি রুটিন কাজ। বন্দীদের সাজার মেয়াদ শেষ হলেই তার সরকার তাকে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করাবে বা করাচ্ছে। এ কাজে সরকারের কূটনৈতিক কোনো ঝামেলা নেই। কিন্তু চোরাকারবারী চক্র, মাফিয়া, মাদক ব্যবসায়ী, খুনের আসামী ও রাজনৈতিক বন্দী প্রত্যাবর্তনে উভয় দেশের কূটনৈতিক বা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় সীমান্তে কোনো সমস্যা দেখা গেলে উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষীরা পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করে থাকেন।

বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জেলে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের প্রত্যাবর্তনে উভয় দেশের সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় একজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরও সে তার নিজ দেশে ফেরত যেতে পারছে না। প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে এসব বন্দীরা তীব্র মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বন্দীদের প্রত্যাবর্তন কাজে সঠিকভাবে বন্দীর পরিবার পরিজনদের খোঁজ বের করা বেশ কষ্টের কাজ। ভারত বা বাংলাদেশের জেল কর্তৃপক্ষ বন্দীদের যে তালিকা দেয় তা অনুসারে উভয় দেশের বিভিন্ন অ লে তাদের পরিবার পরিজনদের খুঁজে বের করতে হয়। বন্দীদের পরিবার পরিজনেরা হারিয়ে যাওয়া স্বজনকে ১/২ বছর খুঁজে, কেউবা থানায় জিডি করে। কিন্তু অনেক সময় কোনো খোঁজ-খবর না পাওয়ায় তারা ধরে নেয় নিখোঁজ ব্যক্তি হয়তো বা মারা গেছে।

সাজার মেয়াদ শেষ এমন বন্দীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে আমি কাজ করছি ২০১৭ সালের প্রথম দিক থেকে। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে এক বৃদ্ধা মায়ের চোখের জল, অনেক বন্দীর করুণ কাহিনী, নীরব চাহনি। ভারতের আসাম রাজ্যের পাথারকান্দির জয়ন্তী বিশ্বাস তার ২৫ বছরের ছেলে প্রাণতোষ বিশ্বাসকে সাথে নিয়ে ২০১৫ সালে অবৈধভাবে বর্ডার অতিক্রম করে বেড়াতে এসেছিলেন বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার জুড়ি উপজেলায় মেয়ে রত্না বিশ্বাসের বাড়িতে। মেয়ের বাড়ি থেকে পুনরায় দালালের মাধ্যমে নিজ দেশে যাবার সময় ২০১৫ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের কুলাউড়া সীমান্তে বিজিবির হাতে মা ও ছেলে গ্রেফতার হলে তাদেরকে আদালতের মাধ্যমে মৌলভীবাজার জেলখানায় প্রেরণ করা হয়। অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে মাননীয় আদালত তাদেরকে ১ মাসের জেল প্রদান করেন।

ছবিতে জয়ন্তী বিশ্বাস ও প্রাণতোষ বিশ্বাস ভারতে প্রত্যাবর্তনকালে আখাউড়া স্থলবন্দরে উভয় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে আমি।

কিন্তু কারাবাসের মেয়াদ শেষ হলেও উভয় দেশের নানান প্রশাসনিক জটিলতার কারণে জয়ন্তী বিশ্বাস ও তার ছেলে প্রাণতোষ বিশ্বাস মুক্ত হয়ে নিজ দেশে যেতে পারছিলেন না। আমি বন্দীদের মুক্তির আদেশ নিয়ে বাংলাদেশের কারা অধিদপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভারতীয় হাই কমিশন ঢাকার সাথে যোগাযোগ করে প্রশাসনিক কাজ সমাধান করতে সক্ষম হই। অবশেষে ২৭.০৫.২০১৭ ইং তারিখে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মা ও ছেলে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মা-ছেলের ঘরে ফিরে যাবার আনন্দে আমার এরকম একটি ব্যতিক্রমী বিষয়ে কাজ করার মানসিকতা আরো বেড়ে যায়। পরবর্তীতে মৌলভীবাজার জেলা কারাগারে সকল ভারতীয় বন্দী নাগরিককে মুক্ত করতে আমি প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করি। সিলেট ও হবিগঞ্জ জেলা কারাগার থেকেও কয়েকজন বন্দীকে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করাতে সক্ষম হই।

(চলবে...)

 অমলেন্দু কুমার দাশ, সহকারী উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা এবং লেখক, লোকগবেষক ও সমাজকর্মী

 

  • খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়