Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ১৩ জুলাই ২০২৫,   আষাঢ় ২৯ ১৪৩২

কামরুল হাসান শাওন, মৌলভীবাজার

প্রকাশিত: ২২:৩৪, ২১ জুলাই ২০২১
আপডেট: ২৩:৩৯, ২১ জুলাই ২০২১

মৌলভীবাজারের প্রান্তিক খামারিদের কোমর ভেঙে দিয়েছে কুরবানির হাট

গরুর খামারি আবদুল মছব্বির মৌলভীবাজার স্টেডিয়ামে পশুর হাটে নিয়ে এসেছিলেন ৬টি গরু। এর মধ্যে দুইটি ষাড়গরুর দাম ওঠে সাড়ে তিন লাখ টাকা। কিন্তু দাম মনপূত হয়নি। আরও বেশি দামে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন আবদুল মছব্বির।

কিন্তু মাঝরাতে বাঁধ সাধে টানা বৃষ্টি। ক্রেতারা অঝোর বৃষ্টির বাগড়ায় হাট ছাড়েন। রাত ৩ টার দিকে ষাঁড় দুটির দাম ওঠে ৮০ হাজার করে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাধ্য হয়ে প্রায় অর্ধেক দামেই বিক্রি করতে হয় গরুগুলো। বিশাল আর্থিক লোকসানে পড়ে বৃষ্টির পানি ও চোখের পানি একাকার হয়ে যায় আবদুল মছব্বিরের। বিগত তিন বছরের শ্রম, আর্থিক বিনিয়োগ আর সমৃদ্ধির স্বপ্ন বৃষ্টির জলে ভেসে যায়।

সদর উপজেলার দীঘিরপাড় বাজারে ঈদের আগের রাতে ষাঁড়সহ ৪টি গরু নিয়ে এসেছিলেন প্রদীপ কুমার। সন্ধ্যারাতে দুটি ষাঁড়গরুর দাম ওঠে ৮৫ হাজার করে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। টানা বৃষ্টির মাঝে ক্রেতাশুন্য হাটে ষাঁড়দুটি বিক্রি করেন প্রতিটি ৪৫ হাজার করে ৯০ হাজারে। গরু দুটি কিনে নেন সন্ধারাতে ১ লাখ ৭০ হাজার দাম হাঁকা সেই ক্রেতা।

রাজনগর উপজেলার মাথিউরা চা বাগানের শ্রমিক কাজল। তার চাচাতো তিন ভাইবোনকে নিয়ে ৪ বছর ধরে একটি ষাঁড়গরু লালন-পালন করে বড় করে। এই ষাড়কে কেন্দ্র করেই বড় হয় তাদের আর্থিক সমৃদ্ধির স্বপ্ন। ঈদের আগে ষাঁড়টির দাম হয় ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। কিন্তু তার আশা ছিলো আরও বেশি দামের, দারিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে আর্থিক সমৃদ্ধ হওয়ার পুঁজিটাও বড় হবে। ঈদের আগের রাতে এই ষাঁড়টিই বিক্রি করতে হয় মাত্র ৭৫ হাজার টাকায়, ক্রেতারা দয়া করে আরও ১৫০০ টাকা বেশি দিয়ে যান কাজলকে। 

করোনাকালীন লকডাউন পরিস্থিতি আর টানা বৃষ্টি খামারিদের স্বপ্ন ও পুঁজি শেষ করে দিয়েছে। লকডাউন পরিস্থিতিতে পুরো জেলাজুড়েই খামারিদের গরু বিক্রি হয়েছে পানির দরে। কুরবানির হাট ঘুরে খামারি ও গরু বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলার প্রায় শতভাগ গরু-ছাগল স্থানীয় প্রান্তিক খামারি উৎপাদন করেছেন। 

খামারি আব্দুল জব্বার আইনিউজকে বলেন, প্রান্তিক খামারিদের কোমর ভেঙে দিয়েছে এ বছরের করোনা-লকডাউনকালীন কুরবানির পশুর বাজার। 

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, এবার জেলায় খামারিদের আর্থিক লোকসান ৭ কোটি টাকার বেশি। তবে স্থানীয় খামারি ও ব্যবসায়ীদের মতে লোকসানের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

কোরবানির পশুর হাটের পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় ক্রেতা শাফায়াত আল রশিদের সাথে। তিনি আইনিউজকে বলেন, শুরুর দিকে বিক্রেতারা কিছুটা হলেও দাম বেশি চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বাজারে তাদের একেবারেই কম দামে গরু বিক্রি করতে হয়েছে। যে গরুর দাম ৭০ হাজার হাঁকা হয়েছিলো সে গরুটিই শেষ বাজারে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শাফায়াত আরও বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে পশুর হাটে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত কাদা হয়ে যায়। এসবের কারণে সেখানে থাকতেই ইচ্ছে করছিলো না। আর এর মধ্যে গরু টেনে নিয়ে আসা বিরাট ভোগান্তির কাজ।

ঈদুল আজহার আগে মঙ্গলবার (২০ জুলাই) পশুর হাটের শেষদিন হঠাৎ করেই দাম কমতে শুরু করে। দিনে বাজার ভালো থাকলেও রাতে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়। তাতে লাভ দূরে থাক, লোকসান দিয়েও পশু বিক্রি করতে পারেননি অনেক বিক্রেতা। ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার গরু ক্রেতারা দাম হাঁকছেন ৮০-৮৫ হাজার। এতে বিশাল লোকসানের মুখে পড়েছেন খামারিরা। 

বাজারে বিক্রি করতে না পারায় বাড়িতে গরু ফিরেয়ে নেন প্রদীপ দাস। তিনি বলেন, এক বছর আগে আমি ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে ২টি গরু কিনেছি এই ঈদে বিক্রি করবো বলে। বাজারে গরু তোলার পর দাম হয় ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। অথচ গরু কেনার পর আমি ৫০ হাজার টাকা মত খরচই করেছি এগুলোর পিছনে। তাহলে আমি কিভাবে গরু বিক্রি করবো এই দামে? তাই বাড়িতে নিয়ে এসেছি পরে ভালো দাম পেলে বিক্রি করবো। 

মৌলভীবাজার জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো আব্দুস ছামাদ জানান, জেলায় এ বছর ১০ শতাংশ গরুও বিক্রি হয়নি। করোনাজনিত কারণে শেষ দিকে দামমন্দা গেছে। গ্রাহকও কম ছিলেন, প্রবাসীরা ক্রেতারা অনেকেই আসতে পারেন নি। সারা দেশেই একই চিত্র, মানুষ বড় গরু কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে।

জানা যায়, জেলায় ৬৮ হাজার গরু প্রস্তুত ছিল। অনেকে খামারে গিয়েই গরু কিনেছেন। অনেক কৃষক গরু ঈদের অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। কিছু কৃষক বেশি দামের আশায় ছিলেন, তাদের নিরাশাই জুটেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরও লোকসান হয়েছে। এবার বাইরের জেলার গরু বাজারে আসেনি।

হবিগঞ্জ এলাকা থেকে ১০ ট্রাকে প্রায় ১০০ গরু জেলায় এসেছিলো। তারা বাজারে দামমন্দা দেখে আর গরু আনেনি। এর মধ্যে কিছু বিক্রয় হয়েছে, বাকিগুলো ফেরত গেছে।

শহরের স্টেডিয়ামের গবাদি পশুর হাটের ইজারাদার মো. শাহাজান বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে সব থেকে বেশি সমস্যা হয়েছে। এর মধ্যে যায়া কিনতে পেরেছে তারা গরু নিয়ে গেছে, যারা পারেনি তারা অন্য গরুর সাথে শরীকান হয়ে কোরবানি দিয়ে দিয়েছে। আমাদের লোকসান হয়েছে শতভাগ।

আইনিউজ/শাওন/এসডি

Green Tea
সিলেট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ