প্রকাশিত: ১২:২৫, ২৪ জুলাই ২০১৯
আপডেট: ১২:৩৪, ২৪ জুলাই ২০১৯
আপডেট: ১২:৩৪, ২৪ জুলাই ২০১৯
গুজবে হত্যা নয়, দেশটা হোক মানবিক
দেবজ্যোতি দেবু
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি।
যখন কলেজে পড়তাম তখন হঠাৎ একদিন দেখলাম কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে একটি ছেলেকে কিছু লোক ‘ধর ধর’ বলে দৌড়াচ্ছে। ছেলেটা বেশি দূর যেতে পারেনি। রাস্তার লোকজন ছেলেটিকে ধরেই দেয় ধোলাই। পিছনে দৌড়ে আসা লোকগুলোও ততোক্ষণে এসে শুরু করলো ধোলাই। দু’তিন মিনিট ধোলাই দেয়ার পর যখন আরো কিছু লোক জটলা পাকালো সেখানে তখন কেউ একজন জিজ্ঞেস করলো ছেলেটিকে ওরা কেন মারছে? আরেকজন দর্শক উত্তর দিলো, ছেলেটা 'চোর'। তখনও কিন্তু কেউই জানে না ছেলেটা আসলে কে এবং কি করেছে।
গুজবে গণপিটুনি নয়, বীরত্ব হোক বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করে।
কিছুক্ষণ পর সেখানে পুলিশ আসলো। পুলিশ এসে প্রশ্ন করলো কি হয়েছে? আপনারা ওভাবে মারছেন কেন ছেলেটিকে? পুলিশ দেখে সকল বীর ততোক্ষণে সটকে পড়েছে। একজন বেশ সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো ছেলেটা 'সন্ত্রাসী'। পুলিশ বললো কি অপরাধ করেছে? লোকটি বললো, জানি না। কিছু লোক ‘খুনি খুনি’ বলে দৌড়াচ্ছিল দেখে আমরা ওকে ধরে ফেলি। এরপর থেকে ও এখানে।
যে লোকগুলো প্রথমে দৌড়াচ্ছিল ছেলেটিকে, তারা ততোক্ষণে কলেজের ভিতরে ঢুকে একটা নিরাপদ জায়গায় বসে গেছে। পুলিশ এসে তাদের জিজ্ঞেস করতে তারা বললো, ছেলেটা 'পকেটমার'। আমাদের গ্রুপের একটা ছেলের পকেট কেটে পালাচ্ছিল। আমরা ধরে ফেলেছি। পুলিশ প্রমাণ চাইলে কেউই কোন প্রমাণ দিতে পারেনি। পরে পুলিশ ছেলেটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর ছেলেটির অভিভাবকেরা গিয়ে অনেক চেষ্টা তদবির করে ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
কিছুদিন পর জানতে পেরেছিলাম ছেলেটি আমাদের কলেজেই পড়তো এবং যারা ওকে প্রথমে তাড়া করেছিল ওরা কলেজেরই রাজনৈতিক দলের লোকজন। পরে বিষয়টা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সবার কাছে। ছেলেটা আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল।
এমন দৃশ্য আগে প্রায়ই দেখতাম। কেউ কাউকে মারতে চাইলে সহজেই রাস্তায় এভাবে তাড়া করতো আর পাবলিক ধরে গণধোলাই দিত। পাবলিকের মাঝখানে সহজেই হাত সাফ করে চলে আসা যেত এবং এর জন্য কোন আইনি ঝামেলায়ও পড়তে হত না। যে লোকটা মার খেত, সেই শুধু জানতো তার আসলে দোষটা কি ছিল। অনেক সময়তো সেও জানতো না কেন মার খাচ্ছে! বাকিরাতো কমেডি দেখে তালি বাজানো দর্শক মাত্র! এখনো যে এমন হয় না তা না। স্কুল-কলেজের গেইটে, বাজারে, শপিং মলের সামনে প্রায়ই দেখা যায় একজনকে ধরে কয়েকজন ধোলাই দিচ্ছে আর বাকিরা দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।
গত কয়েকদিন ধরে ছেলেধরা সন্দেহে গণধোলাই দিয়ে মেরে ফেলার যেন এক উৎসব শুরু হয়েছে! প্রতিদিন খবরের কাগজে ডজনখানেক নির্দোষ মানুষের ধোলাই খাওয়ার সংবাদ পড়তে হয়। দুদিন আগেতো সাড়ে তিন বছরের একটা শিশুর মা'কেও নৃশংসভাবে পিটিয়ে মেরে ফেললো কিছু নরপিশাচ। এই ধোলাই খাওয়ার হাত থেকে প্রতিবন্ধীরাও রেহাই পাচ্ছেন না! সার্বিক অবস্থা সামলাতে সারা দেশের মত সিলেটেও পুলিশের পক্ষ থেকে একটি গণবিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে তারা বলছে, “সাম্প্রতিক সময়ে ‘পদ্মা সেতুতে শিশুর কাটা মাথা ও রক্ত লাগবে’ এমন ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে হত্যার মাধ্যমে একটি কুচক্রী মহল দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পায়তারা করছে। গণপিটুনি দিয়ে হত্যা এবং গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। সিলেট জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় যাতে এ ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেলক্ষ্যে সিলেট জেলা পুলিশের পক্ষ হতে বিভিন্ন প্রচারণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।”
গুজবের বলি হয়ে অতীতে অনেকে খুন হয়েছেন, ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, জেল জরিমানার সম্মুখীনও হয়েছেন। এখন নতুন আতঙ্ক গণধোলাই। এই গণধোলাইও যে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে করছে তাও না। না জেনে, না বুঝে, আইনের তোয়াক্কা না করেই ইচ্ছামত পেটাচ্ছে একজনকে। জেনে বুঝেও যে পেটানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ সেটাও তারা আমলে নিচ্ছে না। ফলে বিনা বিচারেই প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ! অনেকে আবার এই হুজুগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে নিচ্ছে। ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটানোর অব্যর্থ হাতিয়ার হিসেবেও কাজে লাগাছে এই অস্ত্র।
কেন হচ্ছে এমন? একজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মত হিংস্র মনোভাব কিভাবে লালন করতে পারে মানুষ?
দীর্ঘদিন যাবৎ যখন একটি জাতি নানাভাবে নির্যাতিত নিপীড়িত হয়ে বিচার প্রার্থী হয়েও বিচার পায় না তখন স্বাভাবিক কারণেই তার মনের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। আমাদেরও হয়েছে তাই। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সহ যাবতীয় সকল ফৌজদারি অপরাধের বিচার পাওয়া এই দেশে সোনার হরিণ পাওয়ার মত হয়ে গেছে! কখনো টাকার কাছে, কখনো ক্ষমতার কাছে, কখনো আবার সাক্ষী জটিলতায় চাপা পড়েছে ন্যায় বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজে। মানুষ এখন আর দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। তারা আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকেই একমাত্র সমাধান মনে করছে! আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। যে কারণে ক্রসফায়ার, গণধোলাইয়ের মত অমানবিক, নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দিচ্ছে। খুনি 'হারকিউলি'কে হিরো বানাচ্ছে। মানুষ মরলে মরুক সমস্যা নাই। সবার শুধু তড়িৎ বিচার চাই!
ক্রসফায়ারের কুফল সবাই জানে, বুঝে। এরপরও যারা সেটাকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন আজ তারাই আবার গণধোলাই নিয়ে আতঙ্কিত! বছর কয়েক আগেও যারা কুপিয়ে মারাকে 'নাস্তিক মারা' বলে জায়েজ করার চেষ্টায় ছিলেন, আজ তারাও গণধোলাই নিয়ে আতঙ্কিত! মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পুরো বৌদ্ধ পল্লী জ্বালিয়ে দেয়াকে যারা সমর্থন জানিয়েছিলেন, তারাও আজ গণধোলাই নিয়ে আতঙ্কে। কেন ভাই? আজকের এই গণধোলাইয়ের জন্মদাতাতো আপনারাই। প্রতিটা হত্যাকাণ্ডে আপনাদের সমর্থনইতো অন্যদের আস্কারা দিয়েছে বেআইনি প্রক্রিয়ায় মানুষ মারতে। হয়তো বলবেন তখনতো আপনারা কিছুই বলেননি, করেননি, চুপ ছিলেন। ভাই, মৌনতাও যে সম্মতির লক্ষণ সেটাও কি ভুলে গেলেন? প্রকাশ্যে যখন মানুষ মারাকে 'ওয়াজিব' ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন তার প্রতিবাদ না করা এই আপনারাই আজ গণধোলাইয়ের শিকার হচ্ছেন।
আইনি বিচার প্রক্রিয়া যতই দীর্ঘ হোক না কেন, যতই দুর্বল হোক না কেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কিংবা আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন দেয়া একজন সভ্য নাগরিকের কোনভাবেই উচিত না। আপনি যখনই আপনার রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা হারাবেন তখনই আপনি নিজেই রাষ্ট্রের জন্যই হুমকি হয়ে উঠবেন। কারণ, যে কোন সময় আপনি নিজেই বেআইনি কাজে উদ্বুদ্ধ হবেন।
পাশাপাশি রাষ্ট্র ব্যবস্থারও দায় আছে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। সেই দায় থেকেই প্রতিটি নাগরিককে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাখতে আইনি প্রক্রিয়াকে আরো জনকল্যাণমূলক করে তুলতে হবে। বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে দায়সারা মনোভাব দেখালে তার কারণে সৃষ্ট সকল জনবিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের দায় রাষ্ট্র পরিচালককেই নিতে হবে এবং তা আপনারা নিতে বাধ্য।
জনগণের প্রতি বিনম্র অনুরোধ, আপনারা দয়া করে গুজবে মনোযোগী হবেন না। সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে, মাথা কেটে নিতে ছেলেধরারা সক্রিয় সহ যাবতীয় সকল গুজব থেকে দূরে থাকুন। কাউকে এমন গুজব ছড়াতে দেখলে পুলিশকে জানান। ছেলেধরা বলে কাউকে সন্দেহ হলে নিজে হিরো না সেজে পুলিশকে জানান। নিজেদের মধ্যকার হিরোইজমটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। সেই বীরত্ব দেখান কোন বিপদগ্রস্থ মানুষকে উদ্ধার করে। কাউকে মারধোর করে না।
পাশাপাশি সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, সমাজকর্মী, শিক্ষক, সুশীল, সংস্কৃতিকর্মী, ধর্মগুরুদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা সাধারণ মানুষদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করুন। গুজব এবং অপপ্রচার রোধে মানুষকে বোঝান। আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার পরামর্শ দিন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি অনুরোধ, নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করুন। গেইটে পাহারাদার রাখুন। প্রয়োজনে সিসি ক্যামেরা লাগান। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে আলোচনা করুন। নির্দিষ্ট অভিভাবক ছাড়া অন্য কারো কাছে বাচ্চাদের তুলে দিবেন না। প্রয়োজনে পরিচয়পত্রের ব্যবস্থা করুন। কাউকে সন্দেহ হলে সাথেসাথে পুলিশের সাহায্য নিন।
করুন, প্লিজ সচেতনতামূলক কিছু করুন। এই দেশটা মানবিক মানুষের। এই দেশে থেকে অমানবিক আচরণ করা থেকে নিজেকে এবং অন্যদেরকে বিরত রাখুন। প্রয়োজনে সাহায্য পেতে পুলিশ প্রশাসনের হেল্প লাইন ৯৯৯ নাম্বারে কল করুন। বিচার করার দায়িত্বটা রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছেড়ে দিন। এভাবে কাউকে মেরে ফেলবেন না প্লিজ!
লেখক - দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মী
আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের
সর্বশেষ
জনপ্রিয়