Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫,   পৌষ ৮ ১৪৩২

জেসমিন চৌধুরী

প্রকাশিত: ২০:৫৭, ২৩ নভেম্বর ২০২১
আপডেট: ২১:৪৫, ২৩ নভেম্বর ২০২১

আরো একজন `মায়া`

জেসমিন চৌধুরী, লেখক

জেসমিন চৌধুরী, লেখক

এই মেয়েটির ঠিক কী হয়েছিল, তা না জেনেই সেদিন রাত প্রায় আড়াইটার দিকে আমি বাসায় ফিরেছিলাম, কিন্তু ঘুমাতে পারিনি। বাসায় ফেরার পরই এই অভিজ্ঞতার ভয়াবহতা প্রথম আমাকে জাপটে ধরেছিল। দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে বাথরুমের আয়নায় নিজের অক্ষত চেহারার পাশাপাশি মেয়েটার থেঁতলে যাওয়া মুখমন্ডল ভেসে উঠেছিল। আমি কান্নায় ভেংগে পড়েছিলাম। 

সেদিন রাত এগারোটার দিকে বিছানায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। অপরিচিত একটা ইন্টারপ্রিটিং এজেন্সি কোনো একটা ওয়েবসাইট থেকে আমার নাম্বার নিয়ে  কল করেছে।  ইমারজেন্সি  বিভাগে সদ্য ভর্তি হওয়া একজন রোগীর জন্য নারী দোভাষী প্রয়োজন। এতো রাতে নারী দোভাষী পাওয়া যাচ্ছে না। 

এই কাজটা না নেবার পক্ষে অনেকগুলো কারণ ছিল। আমি এই এজেন্সির সাথে রেজিস্টার্ড নই, এই হাসপাতালেও আগে কখনো কাজ করিনি। তাছাড়া এতো রাতে কাজ করতে যাব, ব্যাপারটা অপু কীভাবে নেবে জানি না।  কয় ঘন্টার কাজ তাও তারা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো পরদিন সকালে কলেজে আমার ক্লাস আছে, খুব ভোরে উঠতে হবে। এতোরাতে এসব ঝামেলায় যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আমি ক্ষমা চেয়ে না করে দিলাম।

লাইন কাটতে যাব, এমন সময় পেছন থেকে অপু বলল, 'একটু দাঁড়াও, না বলো না।'  

আমি অপরপক্ষকে অপেক্ষা করতে বলে অপুর দিকে ফিরলাম, 'তুমি বলছ যাব? এতো রাতে?' 

'হ্যাঁ যাও। আমি তোমাকে নামিয়ে দেব, কাজ শেষে আবার নিয়ে আসব। এতোরাতে একটা মানুষ কী বিপদে পড়েছে কে জানে। যাও, তাকে সাহায্য করো।' 

হাসপাতালে গিয়ে রোগীর অবস্থান খুঁজে পেতে বেশ ঝামেলা হলো। ততক্ষণে ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে তাকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। একে তাকে জিজ্ঞেস করে, বিশাল হসপিটালের সুদীর্ঘ নির্জন সব করিডোর ধরে অনেকখানি হাঁটবার পর অবশেষে যখন রোগীকে খুঁজে পেলাম তখন আমার মনে প্রথমেই যে প্রশ্নটা এলো তা হচ্ছে, 'এই রোগীর জন্য কীভাবে ইন্টারপ্রিটিং করব? কী ইন্টারপ্রিটিং করব?' 

দুই পা, এক হাত, এবং প্রায় সমস্ত মুখমন্ডল ব্যান্ডেজে মোড়ানো মেয়েটার নিথর দেহ পড়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা বিছানায়। শুধু, চোখ এবং ঠোঁট আর নাকের খানিকটা দেখা যাচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে নাকটা এবং ঠোঁট দুটো প্রায় থেঁতলে গেছে।  এতো সাদার মধ্যে রক্তের লাল ছোপ ছোপ দাগগুলো পৃথিবীর সমস্ত ভয়াবহতা নিয়ে আর্তনাদ করছে যেন। পাশে বসে আছে একজন নার্স। আমি জানতে চাইলাম এই রোগীর জন্যই আমাকে ডাকা হয়েছে কী না।   

নার্স হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলে আমি  বিস্ময় প্রকাশ করলাম, 'কিন্তু ও তো কথাই বলতে পারবে না! আমি কী ইন্টারপ্রিট করব?' 

'দেখো, ও খুব ভয়াবহ একটা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। দুইদিন বন্দী করে রাখা হয়েছে ওকে, আমরা ধারণা করছি এই দু'দিন ওকে কিছু খেতেও দেয়া হয়নি। খুব সম্ভব ও ইংরেজিও বলতে পারে না। যখন ওর জ্ঞান ফিরবে, আমরা চাই ও যেন নিজের ভাষার একটা কণ্ঠ শুনতে পারে। তোমাকে ইন্টারপ্রিটিং নয়, বরং মেয়েটাকে আশ্বাস দেয়ার জন্যই আনা হয়েছে।' 

মেয়েটাকে কে বন্দী করে রাখল? কেন? এখানে ও একা কেন? ওর আত্মীয় স্বজন সব কোথায়?  অসংখ্য অনুত্তরিত প্রশ্ন মনে নিয়ে আমি দুমড়ানো মোচড়ানো মেয়েটার পাশে বসে রইলাম। দোভাষী হিসেবে  এসব জিজ্ঞেস করার অধিকার আমার নেই। প্রায় একঘন্টা পর মেয়েটা একটু নড়েচড়ে উঠল, মুখ দিয়ে গোংগানোর আওয়াজ বের হতে লাগল। 

নার্স বলল, 'ওকে বলো ওর অবস্থা এখন স্ট্যাবল। আমরা ওর যথাযথ কেয়ার নিচ্ছি। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে'।  আমি অনুবাদ করলাম। 
উত্তরে মেয়েটা কিছু একটা বলবার চেষ্টা করল, আমার মনে হলো দুই তিনটা অস্ফুট শব্দ শুনলাম কিন্তু বুঝলাম না কিছুই। 

নার্সকে বললাম, 'ও সম্ভবত ওর পরিবারের মানুষদের খুঁজছে।' 
উত্তরে নার্স বলল, 'পুলিশ কেইস হয়েছে। ওর স্বামী বা পরিবারের কেউ এখন ওর কাছে আসার অনুমতি নেই।'  

এইটুকু তথ্য থেকে কিছুই পরিষ্কার হলো না। কিন্তু আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হওয়া জরুরী নয়। আমাকে যা বলা হবে, আমি শুধু সেটুকুই ভাষান্তর করব। এখানে কৌতুহলী হতে ডাকা হয়নি আমাকে। 

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে নাটক লেখার সময় তাই মূল চরিত্রের নাম দিয়েছিলাম 'মায়া'। আমার প্রথম উপন্যাস 'একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা' উৎসর্গ করেছিলাম সেই মুখমণ্ডল  থেঁতলে যাওয়া মেয়েটাকে। সে রাতের পর নিজের গোছানো জীবন নিয়ে তৃপ্তি অনুভব করতে পারিনি আর।

আমি মেয়েটার অক্ষত হাতটি আলতোভাবে ধরে বসে রইলাম। মেয়েটি একটু পরপর আমার হাতে চাপ দিতে থাকল, গোংগাতে থাকল। অস্পষ্ট হলেও কিছু শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আমি ওর মুখের কাছে কানটা নিয়ে বুঝতে চাইলাম কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সময়ের সাথে গোঙ্গানির তীব্রতা বাড়তে থাকল। এবার মনে হলো মেয়েটা বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে, ব্যান্ডেজে বাঁধা হাতটাও তুলে ধরার চেষ্টা করছে, পা দু'টো মুচড়ে যাচ্ছে, গোংগানোর শব্দ তীব্রতর হচ্ছে। 

একটু ভেবে আমি নার্সকে বললাম, 'ও কিছু বলতে চাইছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি অনুমতি দিলে আমি একটা কাজ করতে পারি।'  

অনুমতি মিলল। আমি মেয়েটার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, 'আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি কিন্তু আপনার কথা বোঝা যাচ্ছে না কিছুই। আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করি। উত্তর 'হ্যাঁ' হলে হাতটা একটু তুলবেন।' 

তারপর আকাশ পাতাল হাতড়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা কথা বলতে অক্ষম একজন মানুষের যত ধরনের সমস্যা হতে পারে, সব জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, 
'তৃষ্ণা পেয়েছে?'
'প্রস্রাব পেয়েছে?'
'খিদে লেগেছে?'
'ভয় লাগছে?' 
'দুশ্চিন্তা হচ্ছে?' 
'ব্যথা হচ্ছে?' 
'কষ্ট হচ্ছে?' 

এইবার হাত তুলল মেয়েটা। 
'কোথায় কষ্ট হচ্ছে?
হাতে?
পায়ে?
নাকে?
মুখে?
গলায়?' 

আবার হাত তুলল মেয়েটা। আমি নার্সকে বললাম ওর গলায় কষ্ট হচ্ছে। 
আবার প্রশ্ন, 
'কী ধরণের কষ্ট?
ব্যথা?
খুসখুসানি?'

এতোবছর পর আমার স্পষ্ট মনে নেই শেষ পর্যন্ত কীভাবে আবিষ্কার করেছিলাম, ওর গলায় রক্ত জমে আছে বলে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নার্স টিউব জাতীয় কিছু একটা দিয়ে গলার রক্ত বের করে আনার পর মেয়েটা একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এবার ওর অস্ফুট কথাগুলোও কিছুটা স্পষ্ট হতে লাগল। 
  
এই মেয়েটির ঠিক কী হয়েছিল, তা না জেনেই সেদিন রাত প্রায় আড়াইটার দিকে আমি বাসায় ফিরেছিলাম, কিন্তু ঘুমাতে পারিনি। বাসায় ফেরার পরই এই অভিজ্ঞতার ভয়াবহতা প্রথম আমাকে জাপটে ধরেছিল। দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে বাথরুমের আয়নায় নিজের অক্ষত চেহারার পাশাপাশি মেয়েটার থেঁতলে যাওয়া মুখমন্ডল ভেসে উঠেছিল। আমি কান্নায় ভেংগে পড়েছিলাম।  এরপর আয়না থেকে ঐ মুখটা মুছতে অনেক দিন লেগেছিল। আরো বহুবছর লেগেছিল এই কথাগুলো লিখবার শক্তি অর্জন করতে।  

রাতটা আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেই রাতেই নারী অধিকার নিয়ে কাজ করার কথা প্রথম ভাবতে শুরু করেছিলাম।আমার অসম্ভব রকম সাপোর্টিভ সঙ্গীটির পাশে শুয়ে ভীষণ অপরাধবোধে ভুগেছিলাম। মেয়েটাকে হাসপাতালে একা ফেলে এসেছি।  আত্মীয়স্বজন একজনও কেউ ওর পাশে নেই, আর আমি ফিরে এসেছি আমার সুরক্ষিত সুন্দর জীবনে। শুধু ঐ মেয়েটির নয়, যখন যেখানে যত নির্যাতিত নারীর জন্য কাজ করেছি, কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় একটা অসম্ভব মায়া বোধ করেছি, বাসায় ফিরে অপরাধবোধে ভুগেছি। 

ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে নাটক লেখার সময় তাই মূল চরিত্রের নাম দিয়েছিলাম 'মায়া'। আমার প্রথম উপন্যাস 'একজন মায়া অজস্র মধুচন্দ্রিমা' উৎসর্গ করেছিলাম সেই মুখমণ্ডল  থেঁতলে যাওয়া মেয়েটাকে। সে রাতের পর নিজের গোছানো জীবন নিয়ে তৃপ্তি অনুভব করতে পারিনি আর।

(মেমোরিতে আসা এই ঘটনাটা  আমার নিজের চোখে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ পারিবারিক নির্যাতন। ঘটনাটা আট বছর আগের। অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করার জন্য আমার  জানা সমস্ত শব্দকেও অপ্রতুল মনে হয়।)

জেসমিন চৌধুরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক

আইনিউজ ভিডিও

এক পিশাচের নির্মমতা ও একজন দেবদূতের গল্প

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক উৎসবে মুগ্ধ বিদেশিনী

৮০ বছর বয়সে বৃদ্ধা নূরজাহান বেগমের মানবেতর জীবন

প্রকৃতির সন্তান খাসি - খাসিয়া জনগোষ্ঠী

মানসিক চাপ কমাবেন যেভাবে

নীলাদ্রি লেক আমাদের এক টুকরো কাশ্মীর | পাখির চোখে নীলাদ্রি

হাইল হাওরের বাইক্কাবিলে পর্যটক আর পদ্মটুনার ভিডিও ভাইরাল

Green Tea
সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়