রজত গোস্বামী
আপডেট: ২০:১৮, ২৬ জানুয়ারি ২০২২
আমাদের মনু নদী
মৌলভীবাজারের মনু নদী। ছবি - আই নিউজ
'মনু' নামে একজন ঋষি ছিলেন। যিনি এই নদীর উৎপত্তি স্থলে বসে ধ্যান করতেন। ঋষি মনু এই জলধারার তীরে বসে ধ্যান করতেন বলে তৎকালীন সময়ে ঐ এলাকার বাসিন্দাগণ এই জলধারাকে মনু নদী/মনু নদ নাম দিয়েছিলেন। সেই থেকে নদীর নাম 'মনু'।
মনুস্মৃতি - আমাদের প্রিয় নদী মনু নদী। আমার জন্ম মনুপাড়ে। ছাত্রজীবনের ছয়বছর বাদ দিলে, মনুর পাড়েই আমার যাবতীয় কার্যক্রম। আমার গ্রামের বাড়ি ঢেউপাশা, মনু নদীর কূল ঘেষে অবস্থিত। মৌলভীবাজার জেলা শহরে আমাদের পৈত্রিক বাড়িও মনু নদীর পাড়ে। তাই, মনু’র প্রভাব আমার কিংবা আমার পরিবারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ মৌলভীবাজার জেলাবাসীর কাছেও। আশি’র দশক থেকে এখন পর্যন্ত মনু’র কারনে আমরা অনেক নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি, সারাদিন না খেয়ে থেকেছি। ছোটবেলা, গ্রামের বাড়িতে বসবাসের সময়, আমার ঢেউপাশা গ্রাম থেকে মনু নদীর তীর দিয়ে হেঁটে হেঁটে বালিকান্দি আব্দুল মজিদ প্রাইমারী স্কুলে গিয়েছি।
বিকেলবেলা, আমরা ভাইবোন ও প্রতিবেশী বাড়ির সমবয়সীদের নিয়ে বাড়ির পাশে মনু নদীর তীরে এসে বসতাম। প্রতিদিনই দেখতাম বড় বড় নৌকা পাল উড়িয়ে, মাঝি-মাল্লারা গুন টেনে বড় বড় নৌকা নিয়ে যাচ্ছে। তখন ইঞ্জিনের নৌকা বলতে কিছু ছিলো না। হটাৎ কোনদিন দেখতাম লঞ্চ যাচ্ছে। নদীতে ইঞ্জিনের শব্দ শুনে বাড়ি থেকে দৌড়ে নদীর পাড়ে চলে যেতাম লঞ্চ দেখার জন্য। বড়দের কাছ থেকে জানতাম, এই লঞ্চ সার্ভিসের লঞ্চ নয়। বিয়ে বা অন্যকোন উপলক্ষে রিজার্ভ নিয়ে যাচ্ছে। নদীতে প্রায় সব সময়ই ছোট-বড় নৌকা চলাচল করতো। শেরপুর থেকে ব্যবসায়িক মালামাল এসব নৌকা দিয়ে মৌলভীবাজার শহরে নিয়ে আসা হতো।
এরও আগে নাকি মনুমুখ নদীবন্দর থেকে এসব মালামাল নৌকায় মৌলভীবাজার সহ রাজনগর, কুলাউরা উপজেলার নদী তীরবর্তী হাট-বাজারে নিয়ে যাওয়া হতো। তখন মনুমুখ ছিলো বিখ্যাত নদীবন্দর। বিশেষকরে সিলেট অঞ্চলের পাটের সবচাইতে বড় ব্যবসাকেন্দ্র। সেখানে পাটের বড় বড় গোদাম ছিলো। ব্যবসায়ীরা স্থানীয়ভাবে পাট সংগ্রহ করে মনুমুখে পাট গোদামে মজুত রাখতেন। এরপর মনুমুখ থেকে এসব পাট ষ্টিমারে করে নারায়নগঞ্জে চালান দেয়া হতো। মনুমুখের পাট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সেখানে অন্যান্য পণ্যেরও পাইকারী বাজার গড়ে উঠে। পরবর্তীতে মনুমুখ পাটবন্দর মনু নদীর তীব্র ভাঙ্গনের মুখে পড়ে, নদীবন্দরটি আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়।
এরপর ব্যবসায়ীরা শেরপুরমুখী হয়ে পড়েন। কারন তখনো সিলেট অঞ্চলে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের সাথে উন্নত সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। শুধু রেলপথ ও নদীপথই ছিলো ভরসা। শেরপুরের পাইকারী ব্যবসায়ীগণ চাঁদপুর ও ভৈরব নদীবন্দর থেকে পণ্য আমদানী করতেন। আর শেরপুর থেকে সুনামগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার ব্যবসায়ীরা ষ্টিমারে কিংবা নৌকায় করে এসব পণ্য ক্রয়করে নিয়ে যেতেন। ফলে, মৌলভীবাজারের ব্যবসায়-বাণিজ্য তখন অনেকটা মনুনদীর উপর নির্ভরশীল ছিলো। আমার ছেলেবেলায় ও দেখেছি মনুনদীতে বড় বড় নৌকা অবিরত চলাচল করতে। তবে, সড়ক পথের উন্নতির সাথে সাথে মৌলভীবাজারে নৌকায় পণ্য পরিবহন হ্রাস পেতে থাকে, যদিও মনুনদী তখনো নৌ-চলাচলের উপযোগী ছিলো। মৌলভীবাজার শহরের পশ্চিমবাজার খেয়াঘাটের আরো পশ্চিমে ’জাহাজঘাট’ এ নৌকা-ষ্টিমার নোঙর করতো। সেই ’জাহাজঘাট’ এর নাম এখনো লোকমুখে প্রচলিত আছে।
মনু নদ না নদী?
বিজ্ঞজনেরা বলেন মনু নদ। নদ ও নদীর সংজ্ঞা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। একটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- যে সকল নদীর কোন শাখা নদী নাই, সে গুলো ’নদী’ নয় ’নদ’। মনুনদীর কোন শাখা নদী নাই, তাই মনু হচ্ছে 'নদ'। অন্য একটা সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, নদীর নামটা যদি হয় পুরুষ বাচক, তাহলে সেটা নদ, এর শাখা নদী থাকুক বা না থাকুক। যেমন- ব্রহ্মপুত্র, কপোতাক্ষ, মনু ইত্যাদি নাম গুলো মহিলা বাচক নয়, পুরুষ বাচক। তাই আমাদের মনু নদী নয়, নদ। তবে, প্রায় সবাই মনু নদীই বলেন।
নামকরণ
হিন্দুধর্মে বর্ণিত, 'মনু' নামে একজন ঋষি ছিলেন। যিনি এই নদীর উৎপত্তি স্থলে বসে ধ্যান করতেন। ঋষি মনু এই জলধারার তীরে বসে ধ্যান করতেন বলে তৎকালীন সময়ে ঐ এলাকার বাসিন্দাগণ এই জলধারাকে মনু নদী/মনু নদ নাম দিয়েছিলেন। সেই থেকে নদীর নাম 'মনু'। অন্য একটি ব্যাখ্যা ও আছে। ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশে, মনুর উৎপত্তি স্থল থেকে বেশ কয়েকমাইল দূরে ঊনকোটি জেলার ’মনুঘাট’ এলাকায় মনুর সাথে অন্য একটি নদী এসে মিলিত হয়েছে। তাই, মনুঘাট এলাকার নামে মনু নামকরণ হয়েছে। তবে, প্রথমটি বেশি গ্রহনযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।
আমাদের সুখ দুঃখ
১৯৭৪ সাল পর্যন্তই আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে শহরের বাড়িতে প্রায়ই নৌকায় যাতায়াত করতাম। আমাদের বিশেষ সুবিধা এই ছিলো যে, আমাদের ২ টি বাড়িই মনু নদীর তীরে। বাড়ির সামনে নদীর ঘাটে নৌকায় উঠে বসতাম, আর শহরের বাড়ির সামনের ঘাটে (বর্তমানে, সেন্ট্রাল রোডে ভটের ফার্মেসীর বিপরীতে সেই পাকাঘাট এখনো আছে) নৌকা ভিড়তো। স্বাধীনতার পর থেকে, অগ্রহায়ন মাসে বাড়ির ধান নৌকায় করে শহরে নিয়ে আসা হতো। ১৯৭০ এর আগের কোন স্মৃতি প্রখরভাবে আমার মনে না থাকলেও যতটুকু দেখেছি, অগ্রহায়ন/পৌষ মাসে বড় নৌকা নিয়ে ধান ব্যবসায়ীরা আমাদের বাড়িতে ধান কিনতে আসতো। অথচ এখন অগ্রহায়ন/পৌষ মাসে মনুনদীর বুকে ধু ধু বালুচর।
আমাদের গ্রামে কয়েকটি পাটনি (মাঝি/ জেলে) পরিবার ছিলো। মনুনদীতে মাছ ধরাই ছিলো তাদের জীবিকা। মাছ ধরার জন্য প্রত্যেক বাড়ির ডিঙ্গি নৌকা ছিলো। মনেপড়ে, প্রায়ই ভোরবেলা মাছের ঝুড়ি নিয়ে নদীর পাড়ে মাছ আনার জন্য আমরা ভাই-বোনরা চলে যেতাম। বিশেষ করে ইলিশমাছ নিয়ে আসতাম। জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়তো। বড় ইলিশ। মনুনদীর ইলিশের স্বাদ চাঁদপুরের ইলিশকেও হার মানাতো। তাছাড়া, টাটকা ইলিশের স্বাদ, আহা- এখনো যেনো মুখে লেগে আছে।
মনুনদী মৌলভীবাজার থেকে এঁকে বেঁকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে আমাদের ঢেউপাশা গ্রামে পৌঁছার পর, বিশাল মোড় নিয়ে সরাসরি উত্তর দিকে চলে গেছে। অর্থাৎ, নদীটি ঢেউপাশা গ্রামের দক্ষিন ও পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে আমাদের বাড়ির কাছেই দক্ষিন-পশ্চিম কোনে নদীর একটা টেক রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই নদীর স্রোত ঐ টেকে আছড়ে পড়ে এবং প্রায় বছরই টেকের ডান-বাম অংশে তীব্র ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা আমার জন্মের আগে থেকেই চলছে। ৮০ এর দশকের শেষদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী তীর সংরক্ষনের ব্যবস্থা করায়, ভাঙ্গনের তীব্রতা এখন অনেক কমে গেছে, কিন্ত ভাঙ্গন অব্যহত রয়েছে। তবে এর আগেই আমাদের প্রচুর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। যার বর্তমান মূল্য ৫০ লক্ষ টাকার কম হবে না। ঢেউপাশা গ্রামে ভাঙ্গন, আর নদীর বিপরীত তীরে অবস্থিত শ্রীরাই নগর গ্রামের উত্তর পাশে নদীতীরে বিশাল চর জেগে উঠেছে। জেগে উঠা এই চরের জমির মালিকানা কিভাবে নির্ধারিত হয়েছে বা হবে তা আমরা এখনো জানি না। ওই চরে স্বাভাবিকভাবে আমাদের জমিও থাকার কথা। আমাদের বাড়ির দক্ষিন পাশে নদী। ১৯৮৪ সালের আগ পর্যন্ত বাড়ির দক্ষিনে প্রচুর জমি ছিলো। নদীর ভাঙ্গনে সেসব জমিও বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে নদীর বাঁধ নির্মানে আমাদের পুরাতন বসতভিটার একটা অংশ চলে গেছে। অবশ্য ৮০র দশকে আমার বাবা মূল বসতবাড়িটি বিক্রি করে দেন। এর আগেই প্রচুর জমি নদীগর্ভে চলে যায়।
১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালের বন্যার কথা এখনো শহরবাসীর মনে আছে। এরমধ্যে ১৯৮৪ সালের বন্যা ছিলো প্রলয়ঙ্করী। আমরা পারিবারক ভাবে এই বন্যায় উল্লেখযোগ্য ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হই। বিশেষ করে আমাদের সংগ্রহে থাকা মূল্যবান বই, গুরুত্বপূর্ণ দলিল ইত্যাদি পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যায়। ২০১৮ সালে বন্যাতঙ্কে আমরা পরপর তিনরাত নির্ঘুম অবস্থায় পার করি।
এভাবে মনুনদী আমার ও আমাদের ভাই-বোনদের মনে বিশেষ একটি আবেগের নাম। আমার ধারনা, মনুনদী নামক শ্রোতস্বিনীকে আমরা, মানুষরা মেরে ফেলেছি। মনুনদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাঁধাগ্রস্থ করে, এবং নিয়ম মাফিক খনন না করে। সম্ভবত, মনুনদীর অবস্থা সম্পূর্ণভাবে না হলেও বেশীরভাগ স্বাভাবিকতায় নিয়ে আসা যাবে।
মনুনদীর যতকথা
প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের ধলাই জেলার সর্ব দক্ষিনের পাহাড় থেকে দুইটি নদী- মনু ও দেও উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে একই প্রদেশের ঊনকোটি জেলার মনুঘাট নামক স্থানে পরস্পর মিলিত হয়ে মনুনদী নামেই প্রবাহিত হয়ে ঊনকোটি জেলার কৈলাশহর এর কাছে, আর্ন্তদেশীয় সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের তেলিবিল গ্রামে প্রবেশ করেছে। এরপর কুলাউড়া, রাজনগর ও সদর উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মৌলভীবাজার জেলা শহর অতিক্রম করে আরো দূরে গিয়ে সদর উপজেলার মনুমুখে কুশিয়ারা নদীতে পতিত হয়েছে।
ভারত থেকে আমাদের বাংলাদেশে ৫৫টি নদী প্রবেশ করেছে। এই নদীগুলোকে আর্ন্তজাতিক নদী বলা হয়। এই ৫৫টি আর্ন্তজাতিক নদীর মধ্যে আমাদের মনুনদী অন্যতম। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড মনুনদীর পরিচিতি হিসাবে ”উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদী নং-৬৬” বলে চিহ্ণিত করেছে।
উৎপত্তিস্থল থেকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মনুনদীর মোট দৈর্ঘ্য ১৬৭ কিলোমিটার। এরমধ্যে বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য ৮৮ কিলোমিটার। নদীর গড় প্রস্থ ১১১ মিটার। মনুনদী অববাহিকার আয়তন ৫০০ বর্গ-কিলোমিটার। পাহাড় থেকে নেমে আসায় মনুনদী তীব্র খরস্রোতা। বর্ষাকালে নদীটি প্রবল স্রোতে দুইকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়।
মনুনদী সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে মনুনদীর গভীরতা ছিলো ২০ মিটার। বর্তমানে নদীর গভীরতা ১০ মিটার। বর্ষাকালে মনুনদীতে ২৫০ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে মাত্র ১৫ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। প্রতিবছর বর্ষাকালে ৪২ লক্ষ টন পলিমাটি প্রবাহিত হয়। এর বৃহৎ অংশ যদিও স্রোতে ভেসে যায়, কিন্তু উল্লেখযোগ্য পরিমান পলি নদীবক্ষে ও তীরে থিতু হয়ে থেকে যায়। ফলে, নদীবক্ষের উচ্চতা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে এবং জেলার বড় একটি অংশ বন্যার হুমকীতে পড়ছে।
মনুনদী শাসন
এখন পর্যন্ত মনুনদীর উপর ২টি ব্যারেজ বা বাঁধ নির্মান করা হয়েছে। প্রথমটি মৌলভীবাজার জেলার সদর উপজেলার মাতারকাপন এলাকায়। মূলত কাউয়াদিঘী হাওর ও হাওর সংলগ্ন এলাকার ৫৬ হাজার একর জমিতে বোরধান চাষে সেচ সুবিধা প্রদানের জন্য মনুনদী সেচ প্রকল্প গ্রহন করে মাতারকাপনে নদীর উপর ব্যারেজ স্থাপন করে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি ছোট ছোট খালের (ক্যানেল) মাধ্যমে কাউয়াদিঘী হাওরে নিয়ে যাওয়া হয় সেচের জন্য। মনু ব্যারেজের স্লুইস গেটে মোট ৮টি কপাট রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কাউয়াদিঘী ও সংলগ্ন এলাকায় বোর ফসলের জমিকে বন্যা থেকে রক্ষার জন্য মনুনদীর ডান তীরে ৩৭ মাইল দীর্ঘ বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মিত হয়। আবার কাউয়াদিঘীতে অতিরিক্ত পানি হলে, ফসল রক্ষার জন্য পানি অপসারনের লক্ষে কাসিমপুরের কড়াদাইর এলাকায় পাম্পহাউস নির্মান করা হয়। হাওরের অতিরিক্ত পানি এই পাম্পহাউসের মাধ্যমে কুশিয়ারা নদীতে অপসারন করা হয়। ১৯৭৬ সালে মনুনদী সেচ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৩ সালে শেষ হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে কুয়েত সরকার ১০০ কোটি ডলারের যোগান দেয়।
প্রকল্প শুরুর প্রথমদিকে, নদীর বাম তীরে বন্যা প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয় নি, এর ফলে ১৯৮৪ সালের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় মৌলভীবাজার জেলা শহরসহ সংলগ্ন এলাকা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
দ্বিতীয় ব্যারেজটি ভারতসরকার ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের কাঞ্চনবাড়ির কাছে নলকাটা এলাকায় নির্মান করে। এটি নলকাটা ব্যারেজ নামে ত্রিপুরাবাসীর নিকট পরিচিত। নলকাটা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারত শুষ্ক মৌসুমে মনুনদীর পানি একতরফা ভাবে প্রত্যাহার করছে। এতে করে বাংলাদেশ মনুনদীর পানির ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়বে মনুনদী সেচ প্রকল্পে।
মনুনদী সেচ প্রকল্প থেকে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
যে উদ্দেশ্য নিয়ে মনুনদী সেচ প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয়েছিলো, আজ ৩৯ বছর (১৯৮৩- ২০২২) পর এসে বিশ্লেষন করলে, আমরা কি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলাতে পারবো?
মনুনদী সেচ প্রকল্প থেকে আমরা যে উপকার পেয়েছি এবং এই উপকারের বিনিময়ে মৌলভীবাজারবাসীকে যে প্রতিদান (ক্ষতি) দিতে হয়েছে, তা কি সমান? অর্থাৎ প্রত্যাশা থেকে প্রাপ্তি বেশী হলো কি না?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন
১. মনুনদী সেচ প্রকল্প প্রণয়নে কারিগরি ত্রুটি ছিলো। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা তখন বিবেচনা করা হয় নাই। ২. প্রকল্প প্রণয়নের আগে সঠিক ভাবে ব্যয়-উপকার (Cost benefit) এর হিসাব করা হয় নাই। ৩. সার্বিক ভাবে মনুনদী সেচ প্রকল্প এলাকার বাহিরের সংলগ্ন এলাকা নিয়ে সুষ্ঠ পরিকল্পনা করা হয় নাই। ৪. মনুনদী সেচ প্রকল্পে বোর ধান উৎপাদনের বিষয়কেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, কিন্ত খোদ মনুনদীটার কি হাল দাঁড়াবে তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমগ্র প্রকল্পটি একপেশে হয়ে গেছে। যারফলে, মনুনদী আজ মৌলভীবাজারবাসীর দুঃখের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরো কিছু কথা
১. মনুব্যারেজ নির্মানের আগে নদীতে শুষ্ক মৌসুমেও প্রায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ছিলো। ২.মনুব্যারেজ নির্মানের আগে সীমিত পরিসরে হলেও নদীতে নৌচলাচল অব্যহত ছিলো। ৩. প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে নদীর উভয়তীরের প্রাকৃতিক ছড়া গুলোর মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়, ফলে নদী অববাহিকায় বৃষ্টি বা অন্যান্য উৎসের পানি ছড়া দিয়ে নদীতে আসা বন্ধ হয়ে যায়। ৪. মাতারকাপন স্লুইসগেট নির্মানে, স্লুইসগেটের প্রতি দুটি পিলারের মাঝখানে নদীর তলদেশের গভীর থেকে অনেক বেশী উচ্চতায় আর সি সি দেয়াল উঠানো হয় যাতে করে ব্যারেজের কপাটগুলো বন্ধ করা হলে কপাটের মুখ (নীচের অংশ) নিশ্ছিদ্রভাবে আটকে যায়। কপাটের নীচের অংশে এভাবে নদীবক্ষ থেকে অনেক বেশি উচ্চতায় আর সি সি দেয়াল নির্মানের কারনে মনুবক্ষ দ্রুত ভরাট হতে থাকে। মনুব্যারেজ নির্মানের আগে, অতীতে নদী যতটুকু ভরাট হয়নি, মনুব্যারেজ নির্মানের পরে এরচাইতে বেশি ও দ্রুত ভরাট হয়ে গেছে এবং এই ধারা অব্যহত আছে। ফলে বর্ষাকালে নদী তার নিজের পানি নিজেই ধারন করতে পারছে না।
জেনে রাখা ভালো, মনুনদী সেচ প্রকল্প কাউয়াদিঘী হাওর ও সংলগ্ন এলাকায় শুধুমাত্র বোরফসল উৎপাদনের জন্য প্রণয়ন করা হয়। এবং এর জন্যই স্লুইসগেটের, প্রশস্ত বাঁধ, ক্যানেল, পাম্পহাউস, পাম্পহাউসে বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের পরে প্রতিবছর এই স্থাপনাগুলো রক্ষনাবেক্ষনের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যায়ের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
প্রকল্প এলাকায় মোট জমির পরিমান ৫৬ হাজার একর। এরমধ্যে আবাদযোগ্য জমির পরিমান ৪৭,৬১৮ একর। কিন্তু, সবারই জানা, বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় বোরধান চাষ করা হচ্ছে ২২ হাজার একর থেকে ২৭ হাজার একর জমিতে। অর্থাৎ, প্রকল্পে লক্ষমাত্রার চাইতে অনেক কম জমিতে আবাদ হচ্ছে। তাহলে বলা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘ ৩৯ বছরেও বোরফসল আবাদের লক্ষমাত্রা অর্জিত হয় নি। এতে প্রশ্ন থাকে, বর্তমানে প্রকল্প এলাকায় উৎপন্ন ধানের মূল্যের বিপরীতে মৌলভীবাজার, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলার নদীর উভয়তীরে অবস্থিত জনপদের বন্যাজনিত কারনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কতো? নদীতে আগে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যেতো, যা আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি। প্রকল্পের কারনে মনুনদী এখন মাছ শূণ্য। পেশাবদল করে দিনাতিপাত করছে জেলেরা।
উপসংহার
আমাদের মনুনদীর আজকের এই বিবর্ণ অবস্থা প্রাকৃতিক কারনে নয়। মানুষের কান্ডজ্ঞানহীন হিসাব নিকাশের কারনে। এরমধ্যে মরার উপর খারার ঘা হিসাবে উদ্ভব হয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নির্মান করা নলকাটা সেচ প্রকল্প। এখন যে অবস্থা, মনুনদীকে আর পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। আর, প্রকল্প এলাকার বাহিরের জনপদকেও বন্যার আতঙ্ক থেকে মুক্ত রাখার উপায় দেখা যাচ্ছে না। বরং পলি বা বালিতে নদী দ্রুত ভরাট অব্যহত রয়েছে। প্রকল্প এলাকার বাহিরের জনপদকে বন্যার আতঙ্ক থেকে মুক্ত রাখার টেকশই প্রকল্প গ্রহনের কোন আভাস এপর্যন্তই অনুপস্থিত।
এভাবেই আমাদের প্রিয় মনুনদীর জলধারা, মৌলভীবাজার জেলার আশীর্বাদ থেকে পরিবর্তিত হয়ে অভিশাপে পরিনত হয়েছে।
তথ্যসূত্রঃ
১. উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী- মোহাম্মদ রাজ্জাক।
২. বাংলাদেশের নদীকোষ- ড. অশোক বিশ্বাস।
৩. বাংলাদেশের নদ-নদী- ম. ইনামুল হক।
৪. দ্যা বিজনেস ষ্ট্যান্ডার্ড (মার্চ-০১, ২০২০ সংখ্যা)
৫. বাঁধ ভাঙার আওয়াজ (ব্লগ) মার্চ-২৩, ২০০৮
৬. বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এর ব্রুশিয়ার
৭. উইকিপিডিয়া
রজত গোস্বামী, সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’
- করোনা জয় করে সুস্থ হয়েছেন মৌলভীবাজারের ৩ চিকিৎসক