Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৭ জুন ২০২৫,   আষাঢ় ৩ ১৪৩২

শামীমা রিতু

প্রকাশিত: ১৫:০৫, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০
আপডেট: ১৫:০৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২০

অজানাই থেকে গেলেন সিলেটের আধ্যাত্মিক সাধক মায়া শাহ

বিখ্যাত গীতিকার এ কে আনাম লিখেছিলেন- "আমি আইতে সিলেটী ভাইরে যাইতেও পূণ্যভূমি সিলেটে জন্ম নিয়েছেন বাউল আব্দুল করিম, রাধা রমন, শিতালং শাহ, হাছন রাজা, আরকুম শাহ’র মতো গুণী লোককবিরা। যাদের আলোয় আলোকিত হয়েছে পাহাড়-হাওর আর নদি ঘেরা এইল সিলেট। আজ সুরমার ঢেউয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসে তাদের কথা।

‘বাবা শাহ জালালের মাটি সর্ব গুণে খাঁটি/এই মাটিতেই জন্ম মোদের পরিচয় সিলেটী’- মাহতাব ফকিরের এই গানের মতই সিলেটের মাটি সর্বগুণে খাঁটি। কিংবা "শাহজালালের সন্তান সবাই হিন্দু মুসলমান"- কাঁকন ফকিরের এই কলিতেই বাঁধা সকলে। যেখানে সবাই এক বাক্যে অন্তরে লালন করেন "আমরা হক্কল সিলটি"।

এ কে আনাম সুরমা নদীর জল চোখে মেখে তিনি সুরমা লাগিয়েছেন- যার এক কিনারে শাহজালাল আরেক কিনারে নিমাইচাঁদ। চারদিক পাহাড় একদিকে সায়রসম হাওর! কী মনোরম প্রকৃতির শোভা! যেখানে প্রকৃতিই বাউল হয়ে আছে সেখানেই সাধক বাউল মরমী কবিরা জন্ম নিবেন এটাই স্বাভাবিক।

বাউল আব্দুল করিম, রাধা রমন, শিতালং শাহ, হাছন রাজা, আরকুম শাহ, দ্বীন ভবানন্দ শাহসহ অনেকের পদচারনায় ধন্য সিলেটের গৌরবময় সাহিত্য সংস্কৃতি।এর মধ্যে কত জনকে জানি আমরা?

আলোচনায় কেউ কেউ আসলেও অনেকেই রয়ে গেছেন অন্তরালে। আড়ালেই করে গেছেন রূপসাধনা।এমনি একজন অন্তরালের সাধক হলেন শামসুল হুদা চৌধুরী (মায়া শাহ)।

গোলাপগঞ্জের যত গোলাপের সুভাস ধরণী আলোকিত করেছে,মানুষের মাঝে প্রদীপের মত উজ্জ্বল করেছে জ্ঞানকে তাদের মধ্যে একজন হলের শামসুল হুদা চৌধুরী মায়া শাহ।

মায়া শাহ’র পারিবারিক নাম শামসুল হুদা চৌধুরী। তবে তিনি মায়া শাহ নামেই পরিচিত ছিলেন বেশি। ১৯৪৪ সালের ৭ মার্চ বৃহত্তর সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার রাণাপিং পরগণার ফাজিলপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতা মো.মদরিছ আলী ও মাতা শামসুন নাহার চৌধুরী।

ছোটবেলা থেকেই আধ্যাত্মিক ভাবের প্রতি আগ্রহ ছিল মায়া শাহ’র। পাড়াগায়ে হলেও এই পরিবারে শিক্ষার ঝোঁক ছিল বলেই ১৯৬৬ সালে ভাদেশ্বরের বিখ্যাত নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমান এসএসসি) পাশ করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগে ‘পোস্ট মাস্টার’ পদে চাকুরি জীবন শুরু করেস।

তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন সিলেটের টিলাগড় নিবাসী পীর সৈয়দ সিরাজ উদ্দিন। পারিবারিক জীবনে তাঁর সহধর্মিনী ছিলেন মহীয়সী রমণী রাবেয়া হুদা চৌধুরী।

মায়া শাহ ডাক বিভাগের কাজে নিয়োজিত থাকা সত্বেও শত ব্যস্ততার মাঝেও নিজের মনে লালন করেছেন পরমাত্মার রূপ দেখার বাসনা। তাই তো তিনি তাঁর একটি পদেও লিখেছেন-

‘দেখবো বলে রূপ মাধুরী

ফকীর মায়া শাহরই আহাজারি গো...।‘

একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান কিংবা একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি নিজেকে ‘ফকীর’ মনে করতেন। চলাফেরা ছিল অতি সাধারণ। সদাহাস্য মানুষটির কাছ থেকে কেউ কখনো কালো মুখের ব্যবহার পাননি।

দীর্ঘদেহী চাঁদপানা মুখের দিকে তাকালে সকলেই শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। সিলেটে ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত শাহজালাল (রহ) এর একনিষ্ট ভক্ত ছিলেন তিনি। প্রতি বৃহস্পতিবার সারারাত দরগাহে জিকিরে মশগুলে থাকতেন।

তাঁর কর্মস্থল ছিল শাহজালাল (রহ) দরগাহ পোস্ট অফিস। সরকারি নিয়মানুসারে প্রমোশন হলে এই কর্মস্থান পরিবর্তন করার কথা বলা হলে তিনি সরকারি কর্মাদেশ প্রত্যাহার করেন। যা অতি বিরল। এ থেকেই বোঝা যায় কতটা নির্লোভ, সরল এবং সাধক স্বভাব ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে লিখেছেন-

‘কর্মদোষে দন্ডধারীরে মায়া

কর্মদোষ তোর গেল না রে

সাধন ভজন তোর হইল না রে..।‘

দেহপ্রাণে তিনি সবসময় লালন করতেন নিজের সাধনাকে। ইহজগতের বাইরে তিনি কল্পজগতে বিরাজ করতেন। নিজের মনে নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকতেন সবসময়। পরমের সেবায় নিজেকে প্রস্তুত করে তিনি বলেছেন-

‘সখিরে- আসতো যদি প্রাণের বন্ধু

দেখতাম নয়ন ভরিয়া

মায়ার জীবন ধন্যহইত রে সখি

তাহান চরণ সেবিয়া রে..।‘

তিনি ইহজগতের প্রতি লালায়িত ছিলেন না বলেই এমন সব কথা তিনি যেমন লিখতে পেরেছিলেন তেমনি বাস্তবিক জীবনেও পরিচালিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর কাছে জীবন ছিল ক্ষণিকের। তাই তিনি তাঁর গানে বলেছেন-

‘কত খাঁচা আছে পড়ি

সবার পাখি গেছে উড়ি রে

দেখলনা কেউ তাহার ছবি

পড়িয়া রিপুর ধাঁধায়..।‘

কতো মধুর সে কথা, কতো জ্ঞানের সে বাণী; অথচ কতইনা আড়ালে ছিলেন তিনি। এখনো রয়ে গেছেন আড়ালেই। নতুন প্রজন্মের কাছে আব্দুল করিম, রাধা রমন বা হাছন রাজা এই নামগুলো সুপরিচিত থাকলেও তাঁদের কাছ থেকে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছেন মায়া শাহ।

লোকসমাজের অন্তরালে এই মহান ব্যক্তি নিজেকে নিজে চেনার চেষ্টা করেছিলেন। জাগতিক সবকিছু থাকার পরও তিনি বলেছেন-

‘আমি কই আইলাম রে আল্লাহ

আমি কি হইত উপায়…’

তৎকালীন সিলেট অঞ্চলের মরমী সাধক ,বাউল আর মরমী শিল্পীদের সাথে মায়া শাহের ছিলো আত্মার সম্পর্ক । শাহ আব্দুল করিম,বাউল আলী হোসেন সরকার, অন্নদা বাবু, ছাতকের সাবুল মিয়া, মখলিছুর রহমান উদাসী, হরেন্দ্র বাবু, সুনামগঞ্জের গীতিকবি সামসুল মিয়া,গোলাপগঞ্জের আলী মিয়াসহ সিলেট ও সিলেটের বাইরের অনেক মরমী শিল্পীদের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিলো মায়াশাহ’র বাড়ীতে।

তাঁরা সকলেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন এই আত্মভোলা মানুষটিকে। নিয়মিত সুফী গানের আসর বসত তাঁর বাড়ীতে। শোনা যায়, তিনি নিজ হাতে খিঁচুড়ি রান্না করে গ্রামের বাচ্চাদের খাওয়াতেন। সেদিনের সেই বাচ্চারা এখন অনেকেই মধ্যবয়সী কিন্তু মায়া শাহের নিজ হাতে তৈরী খিঁচুড়ির কথা এখনও তাদের কাছে মধুর স্মৃতি।

মায়া শাহের নামের সাথে যে নামটি অবিচ্ছেদ্যভাবে আরও একটি নাম জড়িয়ে আছে। সেটি হলো মাহতাব শাহ ফকীর। মায়া শাহের গানে মোহিত হয়েই সেই সময়ের কিশোর মাহতাব উদ্দিন "মাহতাব শাহ ফকীরে" পরিণত হয়েছেন।

মনে করা হয় যে সেদিনের কিশোর বালক মাহতাব উদ্দিনের মাহতাব শাহ ফকীরে পরিণত হওয়ার পেছনে হাত ছিলো মায়া শাহ’র।  মায়া শাহ’র মায়ার সুর প্রাণে বাজিয়ে তিনি লালন করে যান তাঁর গীত,কথা ও সুর।

মাহতাব শাহ ফকীরের গানের প্রথম হাতেখড়ি হয় মায়া শাহের কাছেই। পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী শ্রী ভবতোষ চৌধুরীর কাছে গান শিখেন ।

এই মহান মরমী সাধক মায়া শাহ ১৯৯৪ সালের ০২ সেপ্টেম্বর দেহত্যাগ করেন। কিন্তু তাঁর গানের প্রাণ এখনো সুরের ভেলায় ভাসায় শ্রোতাদের। সিলেটের মরমী সঙ্গীতে মায়া শাহের অবদান অনস্বীকার্য।আমাদের উচিত তাদের সে অবদান কে মবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া।

২০০৩ সালের মার্চ মাসে মায়া শাহের সহধর্মিণী রাবেয়া হুদা চৌধুরীর সর্বস্বত্ত্বে মাহতাব শাহ ফকির মায়া শাহের গানগুলোকে এক মলাটে আবদ্ধ করেন "মনঃপীড়া" নামে। বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন মুহিত চৌধুরী।

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়