Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শুক্রবার   ১০ অক্টোবর ২০২৫,   আশ্বিন ২৫ ১৪৩২

হাসানাত কামাল

প্রকাশিত: ০০:৫৫, ১০ অক্টোবর ২০২৫
আপডেট: ০১:৪৩, ১০ অক্টোবর ২০২৫

বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনে নীরব বিপ্লব, জলাভূমি রক্ষায় শঙ্কা

বাংলাদেশের হাওর-বিলের মাছ—যা এখন বাজারে খুব কমই দেখা যায়। ছবি - হাসানাত কামাল

বাংলাদেশের হাওর-বিলের মাছ—যা এখন বাজারে খুব কমই দেখা যায়। ছবি - হাসানাত কামাল

বাংলাদেশে নীরবে মাছ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে গেছে। জমি কমে বেড়েছে জনসংখ্যা, কিন্তু চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাছ উৎপাদন। সরকারি তথ্যমতে গত ৫০ বছরে মিঠা পানির জলাশয় কমেছে ৭০ শতাংশ, যেটি মাছ ও বিশুদ্ধ পানির উৎস এবং জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আবাসস্থল।

অন্যদিকে জনসংখ্যা বেড়েছে তিনগুণের কাছাকাছি। দেশে ১৯৭২ সালে যেখানে জনসংখ্যা ছিলো সাড়ে ৭ কোটি। সেখানে ২০২৫ সালে এসে জনসংখ্যা ১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই সময়ে মাছ উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। পঞ্চাশ বছর আগে দেশে মাছ উৎপাদন হতো ৮ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। আর বর্তমানে সেটা ৫০ লাখ মেট্রিকটন ছাড়িয়েছে। তবে, এই সাফল্যের সাথে জলাভূমি রক্ষায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন হাওর প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং স্থানীয় মানুষেরা। 

দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে মূলত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার কারণে। প্রাকৃতিক জলাভূমি কমলেও সেসব জায়গায় স্থান নিয়েছে প্রাইভেট ফিশারিজ বা পুকুর। সেসব পুকুরের মাছ দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। আর প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে তৈরি করা হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম। যেখানে মাছ ধরা নিষেধ। লিজ দেওয়া হয় না। সেখানে নিরাপদে মাছ বড় হয়। আর সেটা বর্ষায় ভাসান পানিতে ছড়িয়ে পড়ে পুরো উন্মুক্ত জলাশয়জুড়ে।

  • বিগত ৫০ বছরে মিঠা পানির জলাশয় কমেছে ৭০ শতাংশ
  • জনসংখ্যা বেড়েছে তিনগুণের কাছাকাছি, তাল মিলিয়ে মাছ উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ
  • মাছ উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ
  • পনেরোবছরে মাছের বিপ্লব
  • বাণিজ্যিক মাছ চাষে হাওরের স্বাভাবিক চরিত্র নষ্ট করা যাবে না
  • জলাভূমি রক্ষায় শঙ্কা
  • ‘আজকাল মাছ চাষের এতো বেশি বিস্তৃতি হয়েছে, যে এখন জলাভূমি আগের মতো আর ন্যাচারাল থাকে না। মানে, জলাভূমি- সেখানে হয়তো পানি আছে, ইকো-সিস্টেমের বাকিটুকু নেই।’ 
  • হাওরে বাণিজ্যিক পুকুরে মাছ চাষ

মৌলভীবাজারের চারটি বড় হাওরের একটি হাইল হাওর। এই হাওরে প্রাকৃতিক জলাশয় কমলেও বাণিজ্যিক পুকুরে মাছ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। সরকারের মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালে এই হাওরে বাণিজ্যিক চাষের পুকুরের পরিমাণ ছিলো ৮৬৩ হেক্টর। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ১৪০০ হেক্টরে। পরিবেশকর্মী ও হাওরপারের মানুষদের ধারণা এর পরিমাণ তিন হাজার হেক্টর ছাড়াবে। 

হাইল হাওর এলাকার একটি বাজারের নাম ’হাজিগঞ্জ’। এই বাজারে নিলামে মাছ বিক্রি হয়। এখান থেকে মাছ কিনে স্থানীয় ভৈরববাজার, মৌলভীবাজার জেলা শহর এবং শ্রীমঙ্গল শহরে চলে যায়। রাজধানী ঢাকার পাইকাররাও এখান থেকে মাছ নিয়ে যান। হাজিগঞ্জ বাজারে কথা হয় মাছ ব্যবসায়ী রইছ উদ্দিনের সাথে। সেখানে রুই, মৃগেলসহ কার্প জাতীয় মাছ বিক্রি হচ্ছিলো। জানতে চাইলে রইছ উদ্দিন বলেন, ‘বাজারের সকল মাছই ফিশারির মাছ (বাণিজ্যিক পুকুরে উৎপাদিত)। ফিশারির মাছই বাজার টিকিয়ে রাখছে, মানুষের চাহিদা পূরণ করছে।’

সিলেট অঞ্চলের সবচেয়ে বড় পাইকারি মাছের আড়ৎ ‘কাজিরবাজার’। যেখানে হাইল হাওর, হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওরসহ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাছ নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। কথা হয় বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হাজী সোনা মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, ‘বাজারে যে মাছ আসে তার ৯০-৯৫ ভাগ মাছই বাণিজ্যিক চাষের পুকুরের। শীত মৌসুমে হাওর-বিলের প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ আসে। বাকি সময়টা সারাদেশের বাণিজ্যিক পুকুরের মাছ ১৮ কোটি মানুষের চাহিদার জোগান দেয়।’

পশ্চিম বাজার ও টিসি মার্কেট মৌলভীবাজার জেলা শহরের প্রধান দুটি কাঁচা বাজার। স্থানীয় ক্রেতা ও মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, শীত মৌসুমে স্থানীয় প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ বাজারে বেশ চোখে পড়ে। মূলত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাওর-বিলের মাছের ভর মৌসুম। বছরের বাকি সময় চাষের মাছের উপর নির্ভর করতে হয়। বাজারের মাছ বিক্রেতা সালাম মিয়া বলেন, ‘ফিশারির (চাষের মাছ) না থাকলে বাজারে মাছই পাওয়া যেতো না। শীত মৌসুমে কয়েক মাস দেশি মাছ (হাওরের মাছ) পাওয়া যায়। বাকিটা সময় এই ফিশারির মাছই ভরসা।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে অনেক সময় চাষের মাছকে হাওরের মাছ বলে বিক্রি করে থাকেন ক্রেতারা। 

হাকালুকি হাওরে মাছ ধরায় ব্যস্ত জেলেরা। ছবি - মো. মোস্তফা

জলাভূমি কমলেও বেড়েছে মাছ উৎপাদন
বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক সার্ভে অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে দেশে জলাভূমির পরিমাণ ছিল ৯৩ লাখ হেক্টর। গত ৫০ বছরে ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৫ লাখ হেক্টর জলাভূমি কমেছে। এখন আছে ২৮ লাখ হেক্টর। 

এদিকে মৎস্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪-৭৫ সালে দেশে মাছ উৎপাদন হতো ৮ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন। দশ বছর পর ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে সেটা অনেকটা কমে যায়। তখন মাছ উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার টন। পরবর্তীতে আবার সেটা ক্রমে বেড়ে যায়। সবচেয়ে বেশি গত ১৫ বছরে দেশে মাছ উৎপাদন বেড়েছে, বলা যায় বিপ্লব ঘটেছে।  ২০২৪ সালে সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন। এরমধ্যে খামারে চাষের মাছের অবদান প্রায় ২৯ লাখ টন বা ৬০ শতাংশের বেশি। মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের প্রায় ২ কোটি অর্থাৎ প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ। এরমধ্যে ১৪ লাখ নারী। সারাদেশে ৫,৭৫৮ হেক্টর অবক্ষয়িত জলাশয় পুনঃখনন ও সংস্কার করা হয়েছে, যা মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। তথ্যসূত্র: মৎস্য অধিদফতর

মাছ উৎপাদনে বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ
মাছ উৎপাদনে এখন বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মিঠাপানির মাছ আহরণে ২০২৪ সালে চীনকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার (এফএও)-এর ‘ওয়ার্ল্ড স্টেট অব ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২৪’ এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

দেশে ২০২৩-২৪ সময়ে মাছের চাহিদা ও ব্যবহারও বেড়েছে। বর্তমানে জনপ্রতি দৈনিক ৬৭.৮০ গ্রাম মাছের চাহিদা রয়েছে। বাৎসরিক ২৩.৭২ কেজি চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ২৫ কেজি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন মাছ ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে ৪ হাজার ৫৩১.৮৬ কোটি টাকা আয় করেছে। 

মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৮৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।  

কিভাবে হলো মাছ উৎপাদন বিপ্লব
মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আরিফ হোসেন বলেন, মৌলভীবাজার জেলায় মাছ ও জলজ প্রাণ-উদ্ভিদের ১০টি অভয়াশ্রম তৈরি করা হয়েছে। যেখানে মাছ, পাখি ও জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের নিরাপদ আশ্রয়স্থণ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরের বাইক্কাবিল অন্যতম। এছাড়া বড়লেখা উপজেলার কৈয়ারকোনা বিল, মইয়াজুড়ি বিল, টোলার বিল, তেকুনি বিল ও নিমু বিল। জুড়ি উপজেলার ইছলার ডাক ও আগদার বিল। কুলাউড়া উপজেলার কাংলি গোবর কুড়ি বিল ও মেদা বিল।

তিনি জানান, মৌলভীবাজার জেলায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৫৭,৩০৫ টন। এ জেলায় মাছের চাহিদা ৫৬,২২০ টন। অর্থাৎ এই অর্থবছর চাহিদার চেয়ে ১,০৮৫ টন বেশি মাছ উৎপাদন হয়েছে। 

এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে মূলত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার কারণে। প্রাকৃতিক জলাভূমি কমলেও সেসব জায়গায় স্থান নিয়েছে প্রাইভেট ফিশারিজ বা পুকুর। সেসব পুকুরের মাছ দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। আর প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোতে তৈরি করা হয়েছে মাছের অভয়াশ্রম। যেখানে মাছ ধরা নিষেধ। লিজ দেওয়া হয় না। সেখানে নিরাপদে মাছ বড় হয়। আর সেটা বর্ষায় ভাসান পানিতে ছড়িয়ে পড়ে পুরো উন্মুক্ত জলাশয়জুড়ে। 

পনেরো বছরে মাছের বিপ্লব
বাংলাদেশের মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে- দেশে মাছের উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে মূলত ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। এই ১৫ বছরে দেশে মাছ উৎপাদন বেড়েছে ৮২ শতাংশ। অধিদফতরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয় ২৭ লাখ টাকা মেট্রিক টন। পরবর্তী পনের বছরে ক্রমে সেটা বেড়ে হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে সেটা ৫০ লাখ টন ছাড়িয়েছে। 

দেশের মাছ উৎপাদনের অন্যতম উৎসস্থল সিলেট অঞ্চল। এই বিভাগে জেলা উপজেলা পর্যায়ে বিগত ১৫ বছর মাঠে কাজ করেছেন নৃপেন্দ চন্দ্র দাস, শফিকুজ্জামান, এমদাদুল হক, মিজানুর রহমান ও সুলতান মাহমুদ। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এই সাফল্যে পেছনে রয়েছে মাছ চাষে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, জলাশয় পুণঃখনন ও সংস্কার, অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ পুনরুদ্ধার-উন্নয়ন ও সহজলভ্যতা, উন্নত হ্যাচারি স্থাপন ও টেকসই মাচ চাষ পদ্ধতির প্রসার।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে- ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশে চাষের পুকুরে মাছ উৎপাদন হতো মাত্র ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। পঞ্চাশ বছর পর এখন চাষের পুকুরে মাছ উৎপাদন হয় ২৯ লাখ মেট্রিক টন। 

মৌলভীবাজার জেলায় হাকালুকি হাওর অধ্যুষিত এলাকায় দীর্ঘদিন প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করছেন সরকারের মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ। এখন তিনি হেডকোয়ার্টারে বসেন। তার কাছে এই প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিলো- গত ৫০ বছরে দেশে জলাভূমি কমেছে ৭০ শতাংশ, কিন্তু মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৮২ শতাংশ। এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে? জবাবে মাঠ পর্যায়ে অভিজ্ঞ এই মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, ‘মূলত উন্নত প্রযুক্তি, উন্নত পোনা, ইনটেনসিফিকেশন এবং মেকানাইজেশনের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। অল্প জায়গায় বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে।’

মাছ উৎপাদনে ইনটেনসিফিকেশন হলো- মাছ চাষের একটি পদ্ধতি, যেখানে কম জায়গায় বেশি মাছ উৎপাদন করা হয়। যেখানে উন্নত প্রযুক্তি, উপযুক্ত পরিবেশ, সার ও সুষম খাদ্য ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পানির গুণমান, খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। 

মেকানাইজেশন হলো- মাছ চাষের ক্ষেত্রে পুকুর, খাঁচা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং অক্সিজেন-খাদ্যের সুষম বণ্টনের একটি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা। 

মৎস্য কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ জানান, বাংলাদেশে ১৯৭১-৭২ সালের দিকে মোট মাছ উৎপাদনের ৮০ শতাংশ আসতো উন্মুক্ত জলাশয় থেকে। বাকি ২০ শতাংশ আসতো চাষের পুকুর ও সাগর থেকে। এখন দেশে মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ আসে চাষের পুকুর থেকে অর্থাৎ বাণিজ্যিক খামার থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ আসে উন্মুক্ত জলাশয় ও সাগর থেকে। 

তিনি বলেন, ‘তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ অল্প জায়গায় বেশি উৎপাদন করা যায়। এটা আগে ছিলো না। এখন সেটা সম্ভব হওয়ায় চাষের মাছের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।’

মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে- দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে ২৬১ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। তবে ৫৬ শতাংশ মাছ আসছে চাষের পুকুর থেকে। পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ।

বছরজুড়ে বাংলাদেশের বাজারে চাষের মাছই ভরসা, সেখানে কিঞ্চিত চোখে পড়ে দুই-একটা প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছ। ছবি - মো. আমির

জলাভূমি রক্ষায় শঙ্কা
বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনে যখন অভূতপূর্ব সাফল্য দেখাচ্ছে, তখন জলাভূমি রক্ষায় শঙ্কা প্রকাশ করছেন জলাভূমি বিশেষজ্ঞ ও হাওর গবেষকেরা। বাংলাদেশে জলজ প্রতিবেশ ও হাওর-বিল বিষয়ে শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘জলাভূমি শুধু মাছ বা কৃষির ভাণ্ডার নয়, বরং এটি পানি ধারণক্ষমতা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।’

তিনি বলেন, ‘এখন মাছের চাষ বেড়েছে। আগে এতো মাছ চাষ হতো না। মুক্ত জলাশয়েই প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। তখন, মানে ৪০-৫০ বছর আগে আমাদের দেশে মাছ চাষের রেওয়াজই ছিলো না। সে সময় মুক্তজলাশয়েই এতো মাছ পাওয়া যেতো, মাছ চাষ করার প্রয়োজন হতো না। যখন মুক্ত জলাশয়ের মাছ কমে গেলো, জলাশয়ও সীমিত হয়ে আসলো। তখনই বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু হলো। এটার দুটো দিকই আছে। কেউ যদি ব্যক্তিগত পুকুর বা এরকম জায়গায় মাছ চাষ করে, তাতে তো কোনো সমস্যা নেই। সেটা যদি অবৈধভাবে মুক্ত জলাশয়ে, সরকারি জায়গা দখল করে, তাহলে সেখানে সমস্যা আছে। অনেকেরই তো ব্যক্তিগত পুকুর, লেক আছে। সেসব জায়গায় চাষ করলে সমস্যা নেই। এমনকি হাওর-বিলের কিছু জায়গায় বিশেষ পদ্ধতি বা উপায়ে চাষ করা যেতে পারে। কিন্তু হাওরের মূল চরিত্রটাকে তো নষ্ট করা যাবে না। মূল চরিত্রটাকে ঠিক রেখে যতটুকু বেনিফিট নেওয়া যেতে পারে।’

মৌলভীবাজারের সাবেক জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ‘অভয়াশ্রম গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। হাওরের বিল লিজপ্রথা বাতিল করে নিবন্ধিত জেলেদের জন্য কার্ড পদ্ধতি চালু করা উচিত। এতে কেউ মা মাছ ও পোনা মাছ ধরতে পারবে না। সাগর এলাকায় যেমন প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে, তেমনি হাওরেও ওই সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে এবং এ সময়ে জেলেদের আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। জলাশয় সেঁচ দিয়ে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা জরুরি। একই সঙ্গে নিষিদ্ধ জাল ও অবৈধ উপায়ে মাছ ধরার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জেলা ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে আর্থিক জরিমানা করার প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন। নিবন্ধিত জেলেদের প্রতিদিনের আহরিত মাছের তথ্য ‘ক্যাচ সার্টিফিকেট’-এর মাধ্যমে নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের প্রাকৃতিক জলাশয়ে আবারও মাছের প্রাচুর্য ফিরে আসবে।’

মাছের অভয়াশ্রম
সিলেট বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতরের তথ্যমতে- শুধু বাইক্ক বিল নয়, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলায় ৩৫টি মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছেরা বংশবিস্তার করছে। পরে তা হাওরে ছড়িয়ে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে মাছের উৎপাদনে। 

তবে, জেলে ও জলাভূমি বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বাইক্কা বিল ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো আদর্শ অভয়াশ্রম গড়ে ওঠেনি। যেটা সত্যিকার অর্থে জলজ উদ্ভিদ, মাছ-পাখি ও জীববৈচিত্যের নিরাপদ আবাসস্থল। 

হাকালুকি হাওরে একটি মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম। ছবি - হাসানাত কামাল

শেষ কথা
সরকারি তথ্য ও স্থানীয় অনুসন্ধানে দেখা যায়, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। তবে জলাভূমির স্বাভাবিক চরিত্র নষ্ট করে মাছ চাষে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

জলাভূমি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন,

‘আগে প্রাকৃতিক ইকোসিস্টেমে নানা ধরনের উদ্ভিদ, পোকামাকড় এবং ছোট-বড় দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। ওই বৈচিত্র্য থাকলেই জলাভূমিতে পশুপাখিরও আধিক্য দেখা যেত। এখন অবশিষ্ট যে জলাভূমি রয়েছে, আমরা হয়তো ধরে নিচ্ছি সেটি আগের ৭০ বা ৫০ শতাংশ। কিন্তু সেই ৫০ শতাংশও আগের মতো নেই। এর চরিত্র পরিবর্তন করে সেখানে মাছ চাষ বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড চলছে, যার ফলে জলাভূমি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।’

পড়ুন বিশেষ প্রতিবেদন: হুমকির মুখে জলাভূমি – বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া হাওর ও বিল রক্ষার উদ্যোগ

আরো পড়ুন: 

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়