Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শুক্রবার   ১০ অক্টোবর ২০২৫,   আশ্বিন ২৫ ১৪৩২

হাসানাত কামাল

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৯ অক্টোবর ২০২৫
আপডেট: ১৮:৫৫, ৯ অক্টোবর ২০২৫

‘হাওরকে ঢাকা শহর করতে চাইলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে’ - সজল কান্তি সরকারের সাক্ষাৎকার

হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার

হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার

হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার, জন্ম ও বেড়ে উঠেছেন সুনামগঞ্জের হাওর জনপদে। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে দেখছেন হাওর প্রতিবেশ, বর্ষায় টইটম্বুর হাওর আর নৌকা জীবন, শুকনো মৌসুমে ধূ-ধূ মাঠ। তিনি আই নিউজ সম্পাদক হাসানাত কামালের সাথে কথা বলেছেন জলাভূমির সংকট ও সম্ভাবনা, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জীবনজীবিকা, নারীর ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। 

তিনি মনে করেন হাওরকে নগরায়ন বা ঢাকা শহর করতে চাইলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে হাওরকে নিয়ে আশাও জেগে আছে তাঁর। সজল কান্তি সরকার বলেন, ‘হাওরকে ঠিকে রাখার সাইকেল হচ্ছে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি, ঝরণা এবং নদী। পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নতুন রূপে হাওরে আসতেছে। সেটিকে ইচ্ছা করলেই আমরা টিকিয়ে রাখতে পারি। কারণ এখন যন্ত্র দিয়ে খুব সহজে হাওর, বিল, নদী, খনন করতে পারি।’

  • ভরাট হয়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে হাওর-বিল
  • যন্ত্র দিয়ে খুব সহজে হাওর, বিল, নদী, খনন করা সম্ভব
  • জলজ নার্সারি, কৃষিবীমা করা অপরিহার্য 
  • বালাইনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে
  • হাওরকে ঠিকে রাখার সাইকেল পাহাড় এখনো টিকে আছে
  • পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নতুন রূপে হাওরে আসতেছে
  • কৃষিকাজের মূল সূত্র তৈরি হয় ঘর থেকে, এর সবই নারীরা করেন
  • এখনো ঠিকে আছে হাওর কেন্দ্রিককিছু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, অনেকে হারিয়ে গেছে
  • সজল কান্তি সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের মূল অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো-

হাওর ভরাট হলে সমুদ্রের নোনা পানি চলে আসবে। একটা সময় সমুদ্রের জোয়ার আসবে। ভিটার ওপর দিয়ে পানি আসলেই বন্যা নয়, মাটির নীচ দিয়ে পানি আসতেছে। নোনা পানি মাটির নীচ দিয়ে চলে আসেব। টিউবওয়েলে নোনা পানি আসবে, পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়বে।

১. হাওরে নারীদের ভূমিকা

প্রশ্ন: হাওরে নারীদের কি ভূমিকা বা সংশ্লিষ্টতা আছে? 

উত্তর: পুরুষরা টিকেই থাকে নারীর শ্রম দ্বারা। শুধু রোপণ করলেই ধান হয় না। ধান ও রবিশস্যের বীজ তৈরিা করা, বীজতলা তৈরির প্রক্রিয়া, পরিকল্পনা, সাহস দেওয়া, টাইমিং, তাগাদা দেওয়া, গরু বের করার তাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজ সবই করেন নারীরা। কৃষিকাজের মূল সূত্র তৈরি হয় ঘর থেকে, এর সবই নারীরা করেন। এখন নারীরা সরাসরি মাঠে চলে যান।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা আগে যেমন সরাসরি মাঠে কাজ করতেন, এখনও তাই করেন। খড় শুকানো, ধান শুকানো, ধান সেদ্ধ দেওয়া সবাই তারা করেন। প্রান্তিক জনপদে রবিশস্য নারীরাই করেন। বুনো বীজ সংগ্রহ করে কৃষির শুরু নারীরাই করেছিলেন। কৃষির শ্রষ্ঠা নারীরাই। এখনও তারা আছেন।

২. হাওর কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

প্রশ্ন: হাওরে বর্তমানে কোন কোন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে। তাদের জীবনজীবকা এখন কোন পর্যায়ে আছে?

উত্তর: সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর এলাকায় কিছু আদিবাসি জনগোষ্ঠী এখনও আছে। যাদের জীবন-জীবিকা হাওর কেন্দ্রিক। এদের মধ্যে গারো, হাজং, বানাই ও কোচ সম্প্রদায় রয়েছে। এক সময় কুকি-নাগা সম্প্রদায় ছিলো, এখন আর নেই। তারা শিকার করে খেতো। এক সময় বেদে সম্প্রদায় ছিলো। এখন তারাও নেই। তাছাড়া মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ অঞ্চলে মণিপুরি সম্প্রদায় আছে। যারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। 

এসব জাতিগোষ্ঠী ধান চাষ, রবিশস্য উৎপাদন ও মাছ ধরার কাজ করেন। এক সময় এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাঁশের শলা ও বেত দিয়ে তৈরি মাছ ধরার উপকরণ ছাই, পারন, ডরি, পলো বানাতেন। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে কৃষি উপকরণ- টুকরি, লাঙ্গল, জোয়াল, মই, ছাতা ইত্যাদি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন কৃষি যান্ত্রিকরণ হওয়ায় এই উপকরণগুলোর চাহিদা নেই। এই অঞ্চলে ৪০-৪২ জাতের বাঁশ পাওয়া যায়। আগে বাঁশ-ছনের ঘর হতো। বাঁশ দিয়ে অনেক উপকরণ হতো। এখন পাকা ঘর হওয়ায় সেই চাহিদাও কমে গেছে।

৩. হাওরের সংকট

প্রশ্ন: হাওরের সংকট কি কি দেখেন?

উত্তর: টাঙ্গুয়াসহ আমাদের হাওরের অন্যতম সংকট দিনের পর দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে জীববৈচিত্র্য; বিশেষ করে জলজ উদ্ভিদসহ অন্যান্য জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে জনজীবনে জনস্বাস্থ্যে প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে হাওরের কৃষক। কোনো ধরনের সচেতনতা ছাড়া আমরা বালাইনাশক ব্যবহার করছি। এতে হৃদরোগ, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বাড়ছে। এগুলো একদিনে হবে না, ধীরে ধীরে হবে। মানুষ বুঝতেছে না, বলতেছে সুস্থ মানুষটা হঠাৎ করে মারা গেছে! কিন্তু কারণ একটাই- অপরিকল্পিত ও অস্বাস্থ্যকর উপায়ে বালাইনাশক ব্যবহার। পোকামাকড় নিধনে স্বাস্থ্যসম্মত উপায় বের করতে হবে। বালাইনাশকে সচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, হাওরকে নগরায়ন বা ঢাকা শহর করতে চাইলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। হাওর ভরাট হলে সমুদ্রের নোনা পানি চলে আসবে। একটা সময় সমুদ্রের জোয়ার আসবে। ভিটার ওপর দিয়ে পানি আসলেই বন্যা নয়, মাটির নীচ দিয়ে পানি আসতেছে। নোনা পানি মাটির নীচ দিয়ে চলে আসেব। টিউবওয়েলে নোনা পানি আসবে, পানিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়বে। খাওয়ার পানি পাওয়া যাবে না। নোনা পানি মিঠাপানির জলাশয়ের সাথে মিশে যাবে, মাটির রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে যাবে। তখন মিঠাপানির উৎস ও কৃষিজমিকে লবণাক্ত করে তুলবে। বন্যা দেখা দেবে। যা কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। 

তিনি বলেন, সমুদ্রের সাথে আমাদের পাহাড়ের তলদেশে অসংখ্য আন্তঃনদীর সংযোগ আছে। ওই পথ ধরে সাগরের পানি চলে আসবে। যখন জলাভূমি ভরাট হয়ে যাবে, তখন এর ওপর দিয়ে পাহাড়ের পানি চূর্ণবিচূর্ণ করে ঢল নেমে বন্যা তৈরি করবে। বাড়িঘর ধ্বংস হবে। 

আরো বড় ঝুঁকি হলো- একটা সময় ডাউকিচ্যুতি ঘটবে। বাংলাদেশ একটা প্লেটের ওপর আছে। দেখা যাবে অতিরিক্ত পানির চাপে ভূ-ত্বকের প্লেট ফেটে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। তখন বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্য আমাদের হাওর-বিল-জলাশয় রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।  

৪. জলাভূমির সম্ভাবনা

প্রশ্ন: জলাভূমির সম্ভাবনা কি দেখেন?

উত্তর: হাওর-বিল-জলাভূমির প্রাণ বৃষ্টির পানি। টাঙ্গুয়াসহ আমাদের সুনামগঞ্জের হাওরের সজীবতার উৎস- মেঘালয় গারো পাহাড় এখনো ঠিকে আছে। পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নতুন রূপে হাওরে আসতেছে, সেটা আসতে থাকবে। বৃষ্টির পানি এখনও নষ্ট হয়নি। হাওরকে ঠিকে রাখার সাইকেল হচ্ছে পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি, ঝরণা এবং নদী। সেটাকে ইচ্ছা করলেই আমরা টিকিয়ে রাখতে পারি। কারণ এখন যন্ত্র দিয়ে খুব সহজে হাওর, বিল, নদী, খনন করতে পারি। জলাভূমিগুলো খনন করে হাওর নিয়ে পরিকল্পনা করা সম্ভব। আগের যুগে মানুষের দ্বারা খাল, নদী, হাওর খনন করা কঠিন ছিলো। এখন যান্ত্রিক যুগে এটা সহজ একটা কাজ। খুবই সম্ভাবনাময় এটা। আর যদি মনে করি হাওরকে ঢাকা শহর বানিয়ে ফেলবো। তখন তো হাওর আর হাওর থাকবে না। 

৫. সমাধানের পথ

প্রশ্ন: সমাধানের পথ কি?

উত্তর: মিঠা পানিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন নাব্যতা রক্ষা করা। পানির গতি প্রবাহ ঠিক রাখা। কার্বন নিঃসরণের জন্য পানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পানি ভালো রাখার জন্য জলজ উদ্ভিদ-বৃক্ষ বাঁচানোর কর্মসূচি নিতে হবে। জলজ বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে- হিজল, করচ, বরুণ ইত্যাদি। এজন্য জলজ উদ্ভিদের নার্সারি করতে হবে। বৃক্ষ রোপণ নয়, বৃক্ষ বাাঁচানো কর্মসূচি নিতে হবে। বালাইনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। উঁচু বেরি বাঁধ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ফসল যেন তলিয়ে না যায়, সেজন্য উঁচু বেরি দেওয়া হয়। কিন্তু এই উঁচু বেরি বাঁধের কারণে পানি প্রবাহ, মাছ ও জলজ উদ্ভিদের স্বাভাবিকতা ব্যাহত হচ্ছে, নদী ভরাট হচ্ছে। সাধারণত পাঁচ বছর পরপর একটা ঝুঁকি তৈরি হয়, বন্যায় ফসল তলিয়ে যায়। সেই ঝুঁকিরোধে কৃষিবীমা করা যায়। প্রাাকৃতিক কারণে যদি ফসল নষ্ট হয়ে, সরকার সে ভর্তুকি দেবে। সাধারণত দেখা যায় বন্যা হলে হাজার কোটি টাকার ত্রাণ দিয়ে দেয়। ত্রাণ না দিয়ে কৃষি ভর্তুকি দেওয়া উত্তম উপায়। বেরি বাঁধ নীচু থাকলে পানি, মাছ, জলজ উদ্ভিদ সবকিছু ঠিক থাকে। এই সম্ভাবনাগুলো জাগিয়ে তুলতে হবে। জলজ নার্সারি, কৃষি বীমা গুরুত্বপূর্ণ। হাওরে মরমী ধারা ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে। এটা মাটি, পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখবে। 

প্রশ্ন: বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর- হাওর মহাপরিকল্পনা করছে। সেটা উন্মুক্ত করে মতামত চেয়েছে। এটাতে ত্রুটি কি দেখেন?

উত্তর: এটা মহাপরিকল্পনার কিছুই হয়নি। ঢাকায় বসে তারা হাওরের কিছুই জানে না। সেখান থেকে তারা মনে করে, পানি আছে, এই, সেই…। হাওরের যে চরিত্র এটা ভিন্ন। হাওরকে শুধুমাত্র জলাশয় ভাবলেই সর্বনাশ। এই মহাপরিকল্পনায় অনেক ত্রুটি আছে। আমরা এটা নিয়ে বসবো। এখানে কি সংযোজন-বিয়োজন করা যায়, সে পরামর্শ দেবো। আমাদের কথা রাখতে পারে, নাও পারে।

হাসানাত কামাল, সম্পাদক, আই নিউজ

পড়ুন বিশেষ প্রতিবেদন: হুমকির মুখে জলাভূমি – বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া হাওর ও বিল রক্ষার উদ্যোগ

জলাভূমি রক্ষায় অভয়াশ্রম স্থাপনই টেকসই সমাধান - অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানের সাক্ষাৎকার

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়