Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ১১ অক্টোবর ২০২৫,   আশ্বিন ২৬ ১৪৩২

হাসানাত কামাল

প্রকাশিত: ০২:১৩, ১১ অক্টোবর ২০২৫
আপডেট: ০৩:৪৯, ১১ অক্টোবর ২০২৫

জমি কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে ধান উৎপাদন

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর ও ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে- ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ছিলো ৮১ লাখ হেক্টর। জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ, বাড়িঘর ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কারণে সেটা ৩০ শতাংশ কমেছে। ২০২৪-২৫ সালে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ৬৯ লাখ হেক্টরে। তখন ধান উৎপাদন হতো ১.১০ কোটি মেট্রিক টন। পঞ্চাশ বছর পর সেটা এখন উৎপাদন হচ্ছে ৪ কোটি মেট্রিক টনেরও বেশি। অর্থাৎ এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ কমলেও বেড়েছে ধান উৎপাদন। 

কিভাবে সম্ভব হলো এই ধান উৎপাদন, এই প্রতিবেদনে সেটা জানার চেষ্টা করবো।

  • বিগত ৫০ বছরে দেশে জমি কমেছে ৩০ শতাংশ
  • জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ
  • জমি কমলেও ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ
  • উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে
  • আধুনিক সরঞ্জাম ও নতুন জাতের বীজের ব্যবহার বেড়েছে
  • বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা’ কর্তৃপক্ষ নামে নতুন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে

বাচ্চারা যখন ছোট ছিলো, তখন তিনবেলা ভাত যোগাড় করা কঠিন ছিলো। পেটের ক্ষুধার কষ্টে তাদের কান্নায়, ভেতরে ভেতরে কাঁদতাম, রক্তক্ষরণ হতো। পুরুষ মানুষ যখন হাওর থেকে কাজ শেষে পরিশ্রম করে ঘরে ফিরতেন। পেটে সবসময় ক্ষুধা লেগে থাকতো। কিন্তু তখন পেটভরে খেতে পেতেন না। নিজে খাবো কি, আর বাচ্চাদের মুখে দেবো কি?

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আথানগিরি গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী মবু মিয়া। বাড়ির পাশে ফসলের মাঠে বৈশাখ মাসে বোরো ধান কাটতে কাটতে বলেন, ‘ফসলের জমি কমে গেছে। আগে যে জমিতে ধান ফলতো, সেখানে এখন মানুষের বাড়িঘর হয়ে গেছে। তবুও দেশে ভাতের অভাব নাই। মাছেরও অভাব নাই। আমরা যখন তরুণ ছিলাম, তখন কিয়ার (৩০ শতকে এক কিয়ার) প্রতি ধান ৪-৫ মণ (৪০ কেজিতে এক মণ) উৎপাদন হতো। কিয়ারে ৭ মণ হলে আমাদের মুরুব্বিরা খুব খুশি হতেন। পরে যখন কিয়ারে ৮-১০ মণ ধান উৎপাদন হলো সবাই তো মহাখুশি। আস্তে আস্তে ধানের উৎপাদন বাড়তে থাকলো। এখন তো কিয়ারে ১৮ থেকে ২৫ মণ ধান উৎপাদন হয়। কারো ৩০ থেকে ৩৫ মণ পর্যন্ত কিয়ার প্রতি ধান উৎপাদন হয়। এ বছর আমি তিন কিয়ার জমিনে ১০৫ মণ ধান পেয়েছি। এগুলো সব সম্ভব হয়েছে ধানের জাতের কারণে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান ফসলের উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কষ্টও কমে গেছে। মেশিনে ধান রোপণ করা যায়, মেশিনে হালিছাড়া হয়। মেশিনে ধান কাটে, মেশিনে মাড়াই দেয়, আবার মেশিনে শুকায়।’ ‘যেভাবে ফসলের জমি কমতেছে, মাছের জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। বাড়িঘর-বিল্ডিং, অবকাঠামো হচ্ছে। ফলন না বাড়লে মানুষ কি খেয়ে বাঁচতো?’ - প্রশ্ন রাখেন মবু মিয়া। 

মৌলভীবাজারের আথানগির হাওরে ধান কেটে ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষক মবু মিয়া। ছবি - হাসানাত কামাল

গ্রামের পিয়ারা বেগম বলেন, ‘বাচ্চারা যখন ছোট ছিলো, তখন তিনবেলা ভাত যোগাড় করা কঠিন ছিলো। পেটের ক্ষুধার কষ্টে তাদের কান্নায়, ভেতরে ভেতরে কাঁদতাম, রক্তক্ষরণ হতো। পুরুষ মানুষ যখন হাওর থেকে কাজ শেষে পরিশ্রম করে ঘরে ফিরতেন। পেটে সবসময় ক্ষুধা লেগে থাকতো। কিন্তু তখন পেটভরে খেতে পেতেন না। নিজে খাবো কি, আর বাচ্চাদের মুখে দেবো কি?’। বলতে থাকনে- ‘হায়রে ভাতের কষ্ট!’  পিয়ারা বেগম বলেন- ‘এখন কেউ ভাতের কষ্ট পায় না। গ্রামের সবাই ভাতে সুখী। বিগত ১৫ বছরে দেশে ধান উৎপাদনে বিপ্লব হয়েছে।’

বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছরে চাষযোগ্য জমি কমেছে ৩০ শতাংশ, জনসংখ্যা বেড়েছে আড়াই থেকে তিনগুণ। কিন্তু এর বিপরীতে দেশে ধান উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। এ বিষয়টি নিয়ে কথা হয় কৃষিবিদ কাজী লুৎফুল বারীর সাথে। বাংলাদেশে অন্যতম বোরো ধান উৎপাদন অঞ্চল সিলেট বিভাগে তিনি কাজ করেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও ব্রাহ্মণব্রাড়িয়া জেলায় সবচেয়ে বেশি বোরো ধান উৎপাদন হয়। কাজী লুৎফুল বারীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওরাঞ্চল নেত্রকোণা জেলায়। 

সর্বশেষ মৌলভীবাজার জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন মাঠ পর্যায়ের এই কৃষি কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘ধান চাষের জমি কমেছে এটা আমাদের জন্য খারাপ খবর। কিন্তু আশার কথা হলো উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। আগে নেটিভ ভেরাইট অর্থাৎ স্থানীয় জাতের ধান চাষ হতো। এখন উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান উৎপাদনে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, বৈজ্ঞানিক কৃষি ব্যবস্থাপনা এবং গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিসের (GAP) কারণে ধান উৎপাদন বেড়েছে। গড়ে প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি ধান উৎপাদন হচ্ছে। নিয়মিত সেঁচ, জমির পরিচর্যা, পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কৃষকেরা ভালো করেছেন বলেই উৎপাদন বেড়েছে। আগামীতে উচ্চ ফলনশীল আরো উন্নত জাতের ধান আসবে, উৎপাদন আরো বাড়বে।’

কৃষিবিদ কাজী লুৎফুল বারী বলেন- ‘হাওর, বিল, জলাভূমি কমেছে। কিন্তু ধান ও মাছ উৎপাদন বেড়েছে। এটা বাংলাদেশের কৃষক-কৃষাণীদের পরিশ্রম, মেধা ও একাগ্রতার ফসল।’

মৌলভীবাজারের কাউয়াদীঘি হাওর এলাকার অন্তেহরি গ্রামে ধান ঝাড়ানোর (ধান বিচালি) কাজ করছেন নারীরা। ছবি - রুপন দাশ

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাম্প্রতিক তথ্যে দেখা গেছে, দেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ কোটি ১০ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় তিন শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৭ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের দেশে মোট বোরো ধান উৎপাদন হয় ২ কোটি ১ লাখ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৯৮ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছিল। প্রতি বছর ধান উৎপাদন হার বৃদ্ধি লক্ষণীয়।  উল্লেখ্য- কৃষি বিভাগের তথ্যমতে দেশের হাওরাঞ্চলে ৬০ শতাংশ বোরো ধান উৎপাদন হয়। বাকি ৪০ শতাংশ হাওরের বাইরে পানির উৎস সংলগ্ন এলাকায় উৎপাদন হয়। 

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে, তার ৮১ শতাংশ উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ হয়েছে। তেরো বছর আগে অর্থাৎ ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ছিল ৭৩ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন শাখার প্রকল্প পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, চলতি বছরে সারা দেশে আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিলো ৪ কোটি ৬ লাখ টন। তবে বোরো ধান মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫৮ ভাগ পূরণ করে থাকে। আউশ অনেকাংশে কম হয়, সারা দেশে ১০ লাখ হেক্টর জমিতে ৪০ লাখ টন আউশ ধান হয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, দেশের মোট ধানের ১০ ভাগের একভাগ উৎপাদিত হয় হাওরে। বছরে তিনটি মৌসুমে হাওরাঞ্চলে ৪ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদ হয়ে থাকে। হাওরাঞ্চলের মধ্যে অধিকাংশ আবাদী জমি হচ্ছে- সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। কৃষকেরা কম্বাইন্ড হারভেস্টারসহ যান্ত্রিক পদ্ধতি এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

সুনামগঞ্জের হাওরে ধান কাটছেন কৃষক। ছবি - মোশাহিদ রাহাত 

এদিকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বিষয়ে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে যে ৬ কোটি ৪৩ লাখ টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে, তার মধ্যে শুধু ধান ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন। যা দেশে মোট দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ফসল উৎপাদন সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। ধানি জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আধুনিক জাতের ফসল ফলানোয় চাল আমদানিও কমেছে। ওই  বছর প্রায় ৫০ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ২০০৫ সালে বোরো ধান আবাদের আওতায় জমি ছিল ৪০ লাখ ৬৪ হাজার হেক্টর।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিআরআরআই) সাবেক মহাপরিচালক জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘দেশে আধুনিক সরঞ্জাম ও নতুন জাতের বীজের ব্যবহার বেড়েছে। কৃষকরা আরও ভালোভাবে জমি প্রস্তুত করছেন, আরও যত্নবান হয়েছেন।’

তবে, এফএও-এর অপর এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি ৩৬ লক্ষ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন।

তবে, হাওরে জমির শ্রেণী পরিবর্তন পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন স্থানীয় কৃষক, জেলে ও পরিবেশবিদেরা। হাওরাঞ্চল ঘুরে জানা গেছে, জলাভূমি শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে এর একটা অংশ ধানি জমিতে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। হাকালুকি হাওরে কথা হয় কৃষক নাজিমুদ্দিন সাথে। তিনি বলেন, ‘হাওরর বিলগুলো প্রথমে প্রথমে ভরাট, পরে ধীরে ধীরে সেটা কৃষি জমিতে রূপান্তর হয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু এলাকায় সেই কৃষি জমিতে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান জলাভূমি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, জমির শ্রেণী পরিবর্তন নিঃসন্দেহে পরিবেশের জন্য হুমকি। জলাভূমিকে আইন দ্বারা রক্ষিত করতে হবে।’

এ ব্যাপারে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর জানিয়েছে, সায়রাতমহাল (খাল-বিল, হাওর, বাওর, বিল, ঝিল ইত্যাদি) হিসেবে বিবেচিত কোনো জমির শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না, যা শুধু মৎস্য এলাকা হিসেবে সংরক্ষিত থাকবে। তবে, যদি প্রাকৃতিক কারণে কোনো জমির শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে জেলা প্রশাসক সেই পরিবর্তিত অবস্থা অনুযায়ী ব্যবহার বিধি নির্ধারণ করতে পারবেন। ‘বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা’ কর্তৃপক্ষ নামে নতুন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। সম্প্রতি ‘ভূমি ব্যবহার ও কৃষি ভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ১৯ আগস্ট খসড়াটি মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। 

পড়ুন বিশেষ প্রতিবেদন: হুমকির মুখে জলাভূমি – বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া হাওর ও বিল রক্ষার উদ্যোগ

আরো পড়ুন

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়