হাসানাত কামাল
হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে স্বপ্ন বুনন

মাছ, পাখি ও জলজ উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম বাইক্কা বিল। ছবি - হাসানাত কামাল
সরকারি হিসাবে হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এরমধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর এবং মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় ৪ হাজার হেক্টর। পরিবেশবিদ ও স্থানীয়রা মনে করছেন দখল ও ভরাট হয়ে এই হাওরের আয়তন ৭ হাজার হেক্টরে কমে এসেছে। এই খারাপ খবরের মধ্যে আছে ভালো খবরও। যা সম্ভাবনা ও কাজ করার তাগিদ দেয়।
দেশের বিস্তীর্ণ জলাভূমি রক্ষায় উল্লেখ করার মতো মডেল হচ্ছে মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল। যেখানে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে, কো-ম্যানেজম্যান্টের (সহ-ব্যবস্থাপনা) মাধ্যমে একটা ব্যবস্থাপনা। একটা বিলকে সংরক্ষণ করেই পুরো হাওরে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ মা মাছগুলো সেখানে থাকতে পারে, ব্রিড (প্রজনন) করতে পারে।
বাইক্কা বিলে মাছ-পাখি, উদ্ভিদ-প্রাণবৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম
সরকারি তথ্যমতে- হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে ১০০ হেক্টর জলাভূমি নিয়ে ২০০৩ সালে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ-প্রাণবৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম গড়ে তুলে মৎস্য অধিদফতর। সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি করে যেটা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
অভয়াশ্রমের পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা লব্বেক মাঝি বলেন, ‘এই বিলে আছে চিতল, বোয়াল, কালো বাউশ, আইড়, লাল পাবদা (মধু পাবদা), কানলা (ফলি), ভেদা (মেনি), লাল টেংরা, কই, মাগুর, কাতল, রুইসহ কার্প প্রজাতির অনেক জাতের মাছ। এগুলো বিলে বংশবিস্তার করে, যা হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। বিলে ৩০-কেজি ওজনের মাছ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা স্থানীয় মানুষেরাই এই অভয়াশ্রম পাহারা দেই। যদিও মাছ ও পাখি শিকার ঠেকাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।’
মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম বাইক্কাবিল। ছবি - মো. মোস্তফা
লব্বেক মাঝি বলেন, ‘বাইক্কা বিল ছাড়াও হাওরের বিভিন্ন বিলে সুস্বাদু অনেক মাছ পাওয়া যায়। যার সুখ্যাতি সারাদেশে রয়েছে। তবে পলিমাটি জমে বিল ও হাওর ছোট হয়ে আসছে। জলাভূমি কৃষি জমিতে শ্রেণী পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এটা চিন্তার বিষয়। দ্রুত হাওর খনন উদ্যোগ নেওয়া খুব দরকার।’ ‘তাছাড়া সেঁচ দিয়ে মাছ ধরার কারণে মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মানুষের সচেতনতার বিকল্প নেই’- যোগ করেন লব্বেক মাঝি।
ন্যাচার ফটোগ্রাফার ও পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী খোকন থৌনাউজাম বলেন, “বাইক্কা বিলের মতো মাছ-পাখির অভয়াশ্রম আমাদের প্রকৃতির জন্য খুব বেশি দরকার। যেটা হবে সত্যিকারের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সংরক্ষণ করবে স্থানীয় মানুষেরাই।
এই বিলে আছে অনেক জাতের পাখি। বছরজুড়ে এখানে স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে থাকে। যেমন কানিবক, ধলাবক, গোবক, ধুপনিবক, রাঙ্গাবক, হলদে বক, নিশি বক, দলপিপি, জলপিপি বা জলময়ুর, বেগুনী কালেম, পান মুরগি, কালোমাথা কাস্তেচরা, কোড়া, ছোট ডুবুরী, শঙ্খচিল, ভুবনচিল, পালাশী কুড়া ঈগল, মেটেমাথা টিটি, হলদে গাল টিটি, কাস্তেচরা, পাতিসরালি,বালি হাস, গয়ার, পানকৌড়ি, ধূসর বক, ইত্যাদি৷
পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে তিলা লালপা, বড় খোপা ডুবুরী, রাজ সরালি, পাতি তিলি হাঁস, মরচে রং ভুতি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, গয়ার বা সাপপাখি, পাতিকুট, বিল বাটান, গেওয়ালা বাটান, কালাপাখ ঠেঙি, লাল লতিকা টিটি, খয়রা কাস্তেচোরা, বন বাটান, বাটান ইত্যাদি৷”
বাইক্কা বিলের আয়তনের ভিন্ন হিসাব দিলেন খোকন। তিনি জানান- চাপড়া বিল, মাগুরিয়া বিল ও যাদুরিয়া বিল; ছোটবড় এই তিনটি বিল নিয়ে ৩৯৬ একর জায়গাজুড়ে বাইক্কা বিল৷ স্থানীয় সংগঠন, ‘বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’ এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় অভয়াশ্রমটি৷
তিনি বলেন- ‘এই জলাভূমিটি জলজ উদ্ভিদের জন্যও সুখ্যাত। এখানে পদ্মটুনা, লাল শাপলা, মাখনা, পানি ফলসহ অনেক জাতের জলজ ফুল-ফল ও উদ্ভিদ পাওয়া যায়।
বাইক্কা বিলে পদ্মটুনাসহ বৈচিত্র্যময় জলজ উদ্ভিদের দেখা মেলে। ছবি - হাসানাত কামাল
বাইক্কা বিলে জলাবন
বাইক্কা বিলের চারপাশে বিস্তৃণ এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে জলাবন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সংগঠন ‘বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’ বনায়ন করেছে। জলাভূমি ও পরিবেশ বান্ধব এসব বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে- হিজল, করচ, তমাল, ঢোল কলমি ইত্যাদি। যেখানে আশ্রয় নেয় পাখি ও নানা প্রাণবৈচিত্র্য।
বনপ্রাণের সুরক্ষা ও সংরক্ষণে কাজ করা সেচ্ছাসেবী সংগঠন Stand for Our Endangered Wildlife (SEW)-এর অন্যতম ফাউন্ডার পরিবেশ কর্মী খোকন থৌনাউজাম বলেন, ‘এটা যেন কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
তবে, কিছু সংকট ও করণীয় তুলে ধরেন এই জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী। তিনি বলেন, ‘বিশাল এই জলাভুমি পাহাড়া দেয়ার জন্য রয়েছে মাত্র তিনজন পাহারাদার৷ যা মোটেই পর্যাপ্ত নয়৷ লোকবল আরো বাড়াতে হবে৷ প্রায়ই দেখা যায় চোরা শিকারীরা রাতের আঁধারে মাছা ধরার জাল পাতে, সকালে তুলে নিয়ে যায়৷ তাছাড়া দিনের বেলাতেই পাহারাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানারকম প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করতে দেখা যায়।’
খোকন থৌনাউজাম বলেন, ‘আশপাশ গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী, প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর, জনপ্রতিনিধি সকলে মিলে এগুলো সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি হাওরে এরকম ২-৩টি অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে পারলে দেশে মাছের অভাব হবে না। পাখিরা নিরাপদ আবাসস্থল পাবে। জলজ উদ্ভিদ বিস্তার লাভ করবে।’
বাইক্কা বিলে জলাবন। ছবি - হাসানাত কামাল
শ্রীমঙ্গল বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব সজল বলেন, বাইক্কা বিল শুধু মাছ, পাখি নয়। এটা সাপ ও বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। এখানে অজগর ও মেছো বিড়ালের আবাস। এই অভয়াশ্রমটি উদাহরণ হিসেবে সারাদেশের জলাভূমিতে বাস্তবায়ন করতে পারলে অনেক ভালো হতো।
হাইল হাওরে বাণিজ্যিক পুকুরে মাছ চাষ
হাইল হাওরে প্রাকৃতিক জলাশয় কমলেও বাণিজ্যিক পুকুরে মাছ উৎপাদনে বিপ্লব ঘটেছে। সরকারের মৎস্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী ২০১৪ সালে এই হাওরে বাণিজ্যিক চাষের পুকুরের পরিমাণ ছিলো ৮৬৩ হেক্টর। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ১৪০০ হেক্টরে। পরিবেশকর্মী ও হাওরপারের মানুষদের ধারণা এর পরিমাণ ৩ হাজার হেক্টর ছাড়াবে।
মাছ ছাড়াও ধানের উর্বরভূমি এই হাইল হাওর। বোরো ফসলের জন্য আদর্শ একটি ফসলের মাঠ এই হাওর।
বাণিজ্যিক পুকুরে মাছ চাষের ব্যাপারে হাওর আন্দোলন মৌলভীবাজারের সভাপতি আসম সালেহ সোহেল বলেন, ‘হাওরের স্বতন্ত্র একটা বৈশিষ্ট আছে। যেখানে মাছের পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম, পোকামাকড়, শামুক-ঝিনুকসহ জীববৈচিত্র্য প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করে। সেই জলাভূমি ধ্বংস করে বাণিজ্যিক মাচ চাষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভেঙ্গে দিচ্ছে।’
দেশের জলাভূমি রক্ষায় বাইক্কাবিল মডেল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও জলাভূমি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘দেশের বিস্তীর্ণ জলাভূমি রক্ষায় উল্লেখ করার মতো মডেল হচ্ছে মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল। যেখানে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে, কো-ম্যানেজম্যান্টের (সহ-ব্যবস্থাপনা) মাধ্যমে একটা ব্যবস্থাপনা। একটা বিলকে সংরক্ষণ করেই পুরো হাওরে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ মা মাছগুলো সেখানে থাকতে পারে, ব্রিড (প্রজনন) করতে পারে। যার মানে মোটের ওপর কিছু অংশ সংরক্ষণ করার ফলে পুরো হাওরেই মাছের উৎপাদন বেড়েছে। যেটার সুবিধা স্থানীয় মানুষই পাচ্ছে। এই মডেলটা দেশের অন্যান্য হাওর-বিলে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে কিছু জায়গা যদি তারা কঠোরভাবে রক্ষিত করে, তাহলে এখানে মাছের বংশবৃদ্ধি হবে। এবং সেখানে পুরো জলাভূমি জুড়েই মাছের উৎপাদন বাড়বে।’
বাইক্কা বিলে বেগুনি কালেম পাখি। ছবি - মো. মোস্তফা
উপসংহার
হাইল হাওরের বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম বাংলাদেশের জলাভূমি সংরক্ষণে একটি উদাহরণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও স্থানীয় মানুষ ও পরিবেশকর্মীরা বাইক্কা বিলের কিছু সংকটের কথাও বলেছেন। যেগুলো সমাধান করলে পরিপুর্ণ মডেল হয়ে উঠবে এই অভয়াশ্রমটি। এছাড়া, বাইক্কা বিল ছাড়া হাইল হাওরের বাকি বিস্তীর্ণ জলাভূমি নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। যেখানে দখল ও ভরাট হয়ে হাওরের প্রকৃত রূপ হারাচ্ছে এই জলাভূমি। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর আইনগত পদক্ষেপ চান পরিবেশ কর্মী ও জলাভূমি বিশেষজ্ঞরা।
পড়ুন বিশেষ প্রতিবেদন: হুমকির মুখে জলাভূমি – বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া হাওর ও বিল রক্ষার উদ্যোগ
আরো পড়ুন:
-
‘হাওরকে ঢাকা শহর করতে চাইলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে’ - সজল কান্তি সরকারের সাক্ষাৎকার
-
জলাভূমি রক্ষায় অভয়াশ্রম স্থাপনই টেকসই সমাধান - অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানের সাক্ষাৎকার
-
বিলীন হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় মাছ ও জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার হাকালুকি
- ফুল | Flower | Eye News
- বিলুপ্ত প্রজাতির গন্ধগোকুল উদ্ধার; লাউয়াছড়ায় অবমুক্ত
- ফ্রি ডাউনলোড-গোলাপ ফুলের ছবি
- শাপলা ফুলের ছবি বৈশিষ্ট্য উপকারিতা ও বর্ণনা
- সুন্দরবন সুরক্ষায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার: পরিবেশমন্ত্রী
- জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উদ্ভিদ প্রজাতির জরিপ করছে সরকার : পরিবেশমন্ত্রী
- জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় ছড়াচ্ছে রোগবালাই
- শুশুক বাঁচলে বেঁচে যায় গোটা জলজ জীবন চক্র
- টর্নেডো: কি, কেন কীভাবে?
- ফুল ছবি | Flower Photo | Download | Eye News