হাসানাত কামাল
আপডেট: ১৯:০৫, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
হুমকির মুখে জলাভূমি – বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া হাওর ও বিল রক্ষার উদ্যোগ
বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম। ছবি- হাসানাত কামাল
ভূমি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বাংলাদেশে গত ৫০ বছরে জলাভূমি কমেছে ৭০ শতাংশ। যা মাছ ও মিঠা পানির উৎস এবং জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আবাসস্থল। কৃষিজমি কমেছে ৩০ শতাংশ। ভরাট, দখল, বসতি স্থাপন, শিল্পায়ন ও নগরায়নে হাওর-বিলগুলো অস্তিত্ব সংকটে, জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে। বন্যা, খরা ও জলবায়ূর প্রভাবে আক্রান্ত জলাভূমি। অন্যদিকে জনসংখ্যা বেড়েছে তিনগুণের কাছাকাছি। আশ্চর্যের বিষয়, জমি কমলেও চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধান ও বাণিজ্যিক খামারে মাছ উৎপাদন। তবে পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন- মাছ চাষের এই সাফল্যের আড়ালে হাওরের মূল চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে!
‘হাওর শুধু মাছ বা কৃষির উৎস নয়, বরং এটি পানির রিজার্ভার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।’ -জলাশয় বিশেষজ্ঞ মনিরুল এইচ খান

- গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে জলাভূমি কমেছে ৭০ শতাংশ, কৃষি জমি কমেছে ৩০ শতাংশ
- ভরাট, দখল, বসতি স্থাপন, শিল্পায়ন ও নগরায়নে হাওর-বিলগুলো অস্তিত্ব সংকটে
- জীববৈচিত্র্য হুমকিতে
- বন্যা, খরা ও জলবায়ূর প্রভাবে আক্রান্ত জলাভূমি
- জনসংখ্যা বেড়েছে তিনগুণের কাছাকাছি
- জমি কমলেও বেড়েছে ধান ও বাণিজ্যিক খামারে মাছ উৎপাদন, শঙ্কায় জলাভূমি
- পথ দেখাচ্ছে বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম, লছিধারা খাল খননসহ স্থানীয় উদ্যোগ
এই অবস্থায় বাংলাদেশের হাওর-বিল রক্ষায় পথ দেখাচ্ছে স্থানীয় কমিউনিটির গড়ে তোলা-মৌলভীবাজারের বাইক্কা বিল অভয়শ্রাম। যেটি এখন মাছ-পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের নিরাপদ আশ্রয় স্থল। জলাভূমি বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাইক্কা বিল হতে পারে একটি আদর্শ মডেল। একই সাথে স্বেচ্ছাশ্রমে কোদালিছড়া সংস্কার, পাখিবাড়িতে নিরাপদ আশ্রম, যুবকদের উদ্যোগে লছিধারা খাল খননসহ কমিউনিটি-ভিত্তিক উদ্যোগগুলো জলাভূমি টিকিয়ে রাখার পথ খুলে দিতে পারে।
হাওর-বিল-জলাশয় এবং কৃষি জমি কতটা হুমকিতে। আবার বাইক্কাবিলের মতো অভয়াশ্রমগুলো যেভাবে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে। ইন্টারনিউজ আর্থ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সহযোগিতায় হাসানাত কামালের এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে- স্থানীয় জেলে, কৃষক, যুবক, নারী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, পরিবেশবিদ ও জলাভূমি বিশেষজ্ঞদের কথা এবং সরকারি পদক্ষেপ।

মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ; জীববৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম বাইক্কাবিল। ছবি- মো. আমির
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা মৌলভীবাজার। যেখানে দেশের সবচেয়ে বেশি হাওর-বিল ও জলাভূমির অবস্থান। এশিয়ার সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি এই জেলায় অবস্থিত। এছাড়া সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেট এবং কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোণা জেলাজুড়ে ছোট-বড় হাওর ও বিল অবস্থিত। জলাভূমি বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেখানে রয়েছে কৃষি, মাছ, পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের সম্ভার। কিন্তু ক্রমেই বিলীন হচ্ছে এসব জলাভূমি। কিছুটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে, কিছুটা প্রাকৃতিক কারণে, কিছুটা স্থানীয় মানুষের অপরিণামদর্শী লোভে, আর অনেকটা অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কারণে। এই অবস্থার মধ্যেও এসব জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেখা যায় নানা উদ্যোগ, যা আশা জাগাচ্ছে।
‘হাওরে অনেক মাছ থাকার কথা। শোল-গজার, টেংরা, পুটি সব ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু মাছ নেই, মাছের পোনাও নেই। যেখানে পানি থাকার কথা সেখানে গরু-মহিষ চড়াচ্ছে।’ – জেলে কটু মিয়া
বাংলাদেশের হাওর ও জলাভূমি
বর্ষায় অথৈ জল, শীতে পাখির উল্লাস, বছরজুড়ে মাছ, জলজ উদ্ভিদ-প্রাণবৈচিত্র্য সমাহারে সমৃদ্ধ দেশের হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলায় চারশতাধিক হাওর। উল্লেখযোগ্য হাওরের মধ্যে রয়েছে হাকালুকি, টাঙ্গুয়া, হাইল হাওর, কাউয়াদীঘি, শনির হাওর, বড় হাওর প্রভৃতি।

বর্ষায় হাকালুকি হাওরের একটা অংশের চিত্র। ছবি- হাসানাত কামাল
- ভরাট হয়ে যাচ্ছে হাকালুকি
‘২০২৪ ও ২০১৮ সালে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা দেখা দেয়, কিন্তু ২০২১ সালে হাওরে পানিই আসেনি। এগুলো মূলত বাংলাদেশে বন্যা ও খরার চিত্র।” – স্থানীয় কৃষক
পলি জমে ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে দেশের বৃহৎ হাওর হাকালুকি। এশিয়ায় মিঠা পানির সবচেয়ে বড় জলাভূমি এটি। স্থানীয় জেলে ও কৃষকেরা বলেন- পানি ধারণ করতে পারছে না হাকালুকি। শুকনো মৌসুমে হাওরের অধিকাংশ জায়গা মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। বর্ষায় পানি উপচে আশপাশ এলাকায় গিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে, দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা তৈরি করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে এই অঞ্চলে। কোনো মৌসুমে বর্ষায় হাওর-নদীর দুইকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার কোনো মৌসুমে উল্টো চিত্র, পানির জন্য হাহাকার।
সম্প্রতি হাকালুকি হাওর পরিদর্শনকালে চোখে পড়ে বর্ষা মৌসুমে পানি সংকটের চিত্র। সাধারণত এই মৌসুমে যেসব জায়গায় পানি থাকার কথা সেখানে পানি নেই। কুলাউড়া উপজেলার গৌরকরণ গ্রাম অতিক্রম করলেই চোখে পড়ে বিস্তীর্ণ হাওর। তবে, হাওরের ভাসান পানি চোখে পড়ে না। কাঁচা সড়ক দিয়ে এগুতেই ফেলুন জাল (ত্রিভূজ আকৃতির মাছ ধরার ছোট জাল) কাঁধে করে হেঁটে আসছিলেন ষাটোর্ধ্ব কটু মিয়া। সময়টা জুলাই ২০২৫। বর্ষা মৌসুমের এই সময়ে হাওরে পানি নেই কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে সড়কে দাঁড়িয়ে আছি, এই সময়ে গলা পর্যন্ত পানি থাকার কথা। হাওরে অনেক মাছ থাকার কথা। শোল-গজার, টেংরা, পুটি সব ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু মাছ নেই, মাছের পোনাও নেই। যেখানে পানি থাকার কথা সেখানে গরু-মহিষ চড়াচ্ছে।

হাকালুকি হাওরের ইসলামগঞ্জ মোহনায় জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলছেন প্রতিবেদক হাসানাত কামাল
গৌরকরণ থেকে এক-দেড় মাইল দূরে হাওরপারে ইসলামগঞ্জ মোহনা। সেখানে বসে আছেন অনেক মাছ ব্যবসায়ী। অপেক্ষা করছেন হাওর থেকে জেলেরা মাছ নিয়ে আসে কি-না। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে কোনো মাছ পেলেন না। নৌকা নিয়ে প্রায় সবাই খালি হাতে পারে উঠলেন। কারো কারো নৌকায় অল্প কিছু ছোট চিংড়ি, পুটি আর বড় মাছের পোনা। এ সময় কথা হয় ৬৫ বছর বয়সী করিম মিয়ার সাথে। তিনি বলেন- ‘হাওরে পানি নেই, তাই মাছও নেই। এটা হাকালুকি হাওরের চিত্র। এক বছর খরা, তো আরেক বছর বন্যা।’
স্থানীয় জেলে ও কৃষকেরা বলেন, ২০২৪ সালে তো বন্যায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ২০১৮ সালেও দীর্ঘমেয়াদি বন্যা দেখা দেয়। তখনও কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ আক্রান্ত হন। কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কিন্তু ২০২১ সালে হাওরে পানিই আসেনি। এগুলো মূলত বাংলাদেশে বন্যা ও খরার চিত্র।
হাকালুকি হাওরকে রামসার স্বীকৃতি দেয়ার দাবি পরিবেশকর্মীদের।
কাউয়াদীঘি হাওরের সংকট
‘সারাদিন হাওর ঘুরে ২০০ টাকার গুড়া (ছোট) মাছও পাওয়া যায় না। কিভাবে সংসার চালাই! এক বছর সব বন্যায় সব ডুবিয়ে দেয়। আরেক বছর সব শুকনা। আমরা কিভাবে বাঁচি!’ – কদম আলী
মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম একটি গুরুত্বপুর্ণ হাওর- ‘কাউয়াদীঘি’। স্থানীয় কৃষকেরা বলেন, মাছ ও ধানের উর্বর ভূমি হলেও সেঁচ সংকটে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, পলি জমে ক্রমেই ভরাট হয়ে উঠছে হাওরটি।
বিগত জুলাইয়ের শেষ-আগস্টের শুরুর সময়ে কাউয়াদীঘি হাওর পরিদর্শন করে দেখা যায়- হাওরে শুকনো জমি। অথচ বর্ষার এই সময়ে ভাসান পানিতে থই-থই করার কথা। সেখানে কথা হয় স্থানীয় জেলে কদম আলীর সাথে। তিনি বলেন- ‘এই মৌসুমে হাওরে কোথাও সাঁতার, কোথাও বুকপানি, আবার কোথাও কোমর পানি থাকার কথা। শাপলা-শালুকে ভরে যায় হাওর। তার মাঝখান দিয়ে সাঁই করে চলে নৌকা। পথ-ঘাট, মাঠ পানিতে ডুবে থাকার কথা। হাওরের ভাসান পানিতে মাছের ঘাই, ঝাঁকে ঝাঁকে পুটি, চান্দা, দারিকনাসহ ছোট মাছ ঘুরে বেড়ায়। শোল-গজার, টাকি রঙবেরঙের পোনা নিয়ে দলে দলে ঘুরে বেড়াতো। সেই হাওরে পানি নেই। হাওরের প্রায় অর্ধেক শুকনা। অনাবৃষ্টি আর দীর্ঘ খরায় চিরচেনা রূপে নেই কাউয়াদীঘি। হতাশা ব্যক্ত করেন কদম আলী। তিনি বলেন, ‘সারাদিন হাওর ঘুরে ২০০ টাকার গুড়া (ছোট) মাছও পাওয়া যায় না। কিভাবে সংসার চালাই!’ তিনি বলেন, ‘এক বছর সব বন্যায় সব ডুবিয়ে দেয়। আরেক বছর সব শুকনা। আমরা কিভাবে বাঁচি!’

কাউয়াদীঘি হাওরের একটা চিত্র। ছবি- রনজিত জনি
তবে, মধ্য আগস্টে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, জলে টইটম্বুর হয়ে উঠেছে কাউয়াদীঘি হাওর। বিলম্বে আসা এই পানি মাছের প্রজনন এবং জলজ উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে জানান সেখানকার জেলে ও কৃষকেরা।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজারের সাবেক জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, জলবাযু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া হাওর ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এটা তারই প্রতিফলন।
পূবের হাওর ও স্বপ্নভঙ্গ
মৌলভীবাজার জেলা সদরের পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ একটি জলাভূমি- ‘পূবের হাওর’, যেটি বড় হাওরের সাথে সংযুক্ত। এটি ধান ও মাছের উর্বর উৎসস্থল। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এই হাওরের উপর নির্ভরশীল। তারা চোখের সামনে কৃষি জমি ও জলাশয় বিলীন হওয়া রূপান্তরগুলো দেখছেন। পার্শ্ববর্তী আথানগিরি গ্রামের বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘এই হাওর আমাদের জীবিকার অংশ। গ্রামের ৯৮ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবি। এই হাওরের ধান না পেলে মানুষ দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়বে। সেই হাওরের ধান উৎপাদন বন্ধ হওয়ার সমস্ত আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। হাওরে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। শুধু ধান নয়, হাওরের গরু ও ছাগল চড়ানোও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’

পূবের হাওরে আথানগিরি অংশে নির্মাণাধীণ সোলার প্যানেল প্রকল্প, শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যেটি ছিলো আশেপাশের কৃষিনির্ভর কয়েকটি গ্রামের হাজারো মানুষের ধান উৎপাদনের ভূমি। ছবি- আই নিউজ
আথানগিরি গ্রামের ষাটোর্ধ্ব মুরুব্বি কানাই মিয়া বলেন, ‘এখন হাওরে মানুষের বাড়িঘর। কোম্পানি এসে প্রকল্প করে ফেলতেছে। এভাবে চোখের সামনে সব বদলে যাচ্ছে!’
পূবের হাওরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গোপলা নদী। সেই গোপলাও ভাঙ্গন ও পলি জমে সরু হয়ে যাচ্ছে।
হাওরের ওপর নির্ভরশীল মানুষজন চোখের সামনে কৃষি জমি ও জলাশয় বিলীন হওয়া রূপান্তরগুলো দেখছেন। গ্রামের মানুষের পাশাপাশি এতে উদ্বিগ্ন পরিবেশকর্মী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণবিদেরাও।

ভাঙ্গন ও পলি জমে সরু হয়ে যাচ্ছে গোপলা নদী। ছবি- হাসানাত কামাল
মৌলভীবাজার হাওর আন্দোলনের সদস্য সচিব খছরু চৌধুরী বলেন, ’এই হাওরকে রক্ষা করা না গেলে শুধু ২৩০ প্রজাতির মাছই হারিয়ে যাবে না, একই সাথে হারিয়ে যাবে আমাদের জীববৈচিত্র্য ও প্রাণ প্রকৃতি। হাওরে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের শামিল।’
পানিতে তলিয়ে যাবে বাংলাদেশ!
বাংলাদেশ একটা প্লেটের ওপর আছে। দেখা যাবে অতিরিক্ত পানির চাপে ভূ-ত্বকের প্লেট ফেটে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। তখন বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। - সজল কান্তি সরকার

শুকনো মৌসুমে এভাবেই জমি ফেটে চৌচির হয়ে যায় বাংলাদেশের হাওরের অধিকাংশ ভূমি। ছবিটি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে তোলা। ছবি- হাসানাত কামাল
একটা সময় বাংলাদেশ পানির নীচে তলিয়ে যাবে বলে মনে করেন হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার, যিনি বেড়ে উঠেছেন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে।
তিনি মনে করেন, হাওরকে নগরায়ন বা ঢাকা শহর করতে চাইলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। হাওর ভরাট হলে সমুদ্রের নোনা পানি চলে আসবে। একটা সময় সমুদ্রের জোয়ার আসবে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাটির নীচ দিয়েও পানি আসতেছে। একটা সময় টিউবওয়েলে নোনা পানি আসবে, আর্সেনিকের পরিমাণ বাড়বে। খাওয়ার পানি পাওয়া যাবে না। নোনা পানি মাটির রন্দ্রে রন্দ্রে ঢুকে যাবে। তখন মিঠাপানির উৎস ও কৃষিজমিকে লবণাক্ত করে তুলবে। বন্যা দেখা দেবে। যা কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে।’
তার মতে, সমুদ্রের সাথে আমাদের পাহাড়ের তলদেশে অসংখ্য আন্তঃনদীর সংযোগ আছে। ওই পথ ধরে সাগরের পানি চলে আসবে। যখন জলাভূমি ভরাট হয়ে যাবে, তখন এর ওপর দিয়ে পাহাড়ের পানি চূর্ণবিচূর্ণ করে ঢল নেমে বন্যা তৈরি করবে। বাড়িঘর ধ্বংস হবে।
তিনি বলেন, ‘আরো বড় ঝুঁকি হলো- একটা সময় ডাউকিচ্যুতি ঘটবে। বাংলাদেশ একটা প্লেটের ওপর আছে। দেখা যাবে অতিরিক্ত পানির চাপে ভূ-ত্বকের প্লেট ফেটে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। তখন বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্য আমাদের হাওর-বিল-জলাশয় রক্ষায় এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।’
তবে, এ বিষয়টি সরাসরি সমর্থন করেননি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি সম্পদ প্রকৌশলী এবং সেন্ট্রার ফর ইনভায়রনমেন্ট এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের পরিচালক মালিক ফিদা আব্দুল্লাহ খান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাওরাঞ্চলটি ব্যতিক্রমীভাবে নিম্নভূমির ভূ-প্রকৃতি দ্বারা গঠিত, যা বন্যা এবং আপেক্ষিক সমুদ্রপৃষ্ঠের সামান্য পরিবর্তনের জন্যও সংবেদনশীল। হাওরের প্রায় ৫০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩–৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং প্রতিবছর ভূমি ২–৪ মিলিমিটার হারে নিচে নামছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ আরও বেড়ে গেলে মেঘনা অববাহিকার পানি নিষ্কাশন ধীর হয়ে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেবে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ভূতত্ত্ববিদ সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘যিনি এটা বলেছেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত ধারণা হতে পারে। এ বিষয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা গবেষণালব্ধ তথ্য নেই।’
Read more: Consequences and Implications of Climate Change for the Haor Region: Malik Fida A. Khan
বালাইনাশক ব্যবহারে জনজীবনে জনস্বাস্থ্য প্রভাব
সজল কান্তি সরকার বলেন, কোনো ধরনের সচেতনতা ছাড়াই বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে জীববৈচিত্র্য; বিশেষ করে জলজ উদ্ভিদসহ অন্যান্য প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্যে প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে হাওরের কৃষক। হৃদরোগ, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বাড়ছে।’ পোকামাকড় নিধনে স্বাস্থ্যসম্মত উপায় বের করতে হবে, বালাইনাশকে সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন এই হাওর গবেষক।
হাওর-বিল রক্ষায় পথ দেখাচ্ছে বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম
বাংলাদেশে হাওর-বিল রক্ষা যেখানে শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে মৌলভীবাজারের হাইল হাওরের বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম জলাভূমি রক্ষায় পথ দেখাচ্ছে। সরকারি তথ্যমতে- হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে ১০০ হেক্টর জলাভূমি নিয়ে ২০০৩ সালে মাছ ও জলজ উদ্ভিদ-প্রাণবৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা হয়। সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটি করে যেটা রক্ষণাবেক্ষণ করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ‘বড় গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা সংগঠন’ এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় অভয়াশ্রমটি৷

জলজ উদ্ভিদ আর প্রাণবৈচিত্র্যের ভাণ্ডার সহ-ব্যবস্থাপনা নির্ভর অভয়াশ্রম বাইক্ক িবিল। ছবি- মো. আমির
অভয়াশ্রমের পার্শ্ববর্তী গ্রামের বাসিন্দা লব্বেক মাঝি বলেন, ‘এই বিলে আছে চিতল, বোয়াল, মধু পাবদাসহ কার্প প্রজাতির অনেক মাছ। এগুলো বিলে বংশবিস্তার করে, যা হাওরে ছড়িয়ে পড়ে। বিলে ৩০-৫০ কেজি ওজনের মাছও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা স্থানীয় মানুষেরাই এই অভয়াশ্রম পাহারা দেই। যদিও মাছ ও পাখি শিকার ঠেকাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।’
ন্যাচার ফটোগ্রাফার ও পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী খোকন থৌনাউজাম বলেন, ‘এখানে আছে নানা প্রজাতির স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও জলাবন, যা জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করছে। বাইক্কাবিলের মতো মাছ-পাখি ও জীববৈচিত্র্যের অভয়াশ্রম আমাদের প্রকৃতির জন্য খুব বেশি দরকার। সংরক্ষণ করবে স্থানীয় মানুষেরাই। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী, প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর, জনপ্রতিনিধি সকলে মিলে এগুলো সংরক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন।’
তবে, সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মী খোকন থৌনাউজাম । তিনি বলেন, ‘বিশাল এই জলাভুমি পাহারা দেয়ার জন্য রয়েছে মাত্র তিনজন পাহারাদার, যা মোটেই পর্যাপ্ত নয়৷ প্রায়ই দেখা যায় চোরা শিকারীরা রাতের আঁধারে মাছ ধরার জাল পাতে, সকালে তুলে নিয়ে যায়৷ আবার দিনের বেলাতেই পাহারাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানারকম প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হয়।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান জলাভূমি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘হাওর রক্ষায় বাইক্কাবিল আমাদের দেশে খুব ভালো একটা মডেল। সেখানে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে, কো-ম্যানেজম্যান্টের মাধ্যমে একটা বিলকে সংরক্ষণ করেই পুরো হাওরে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ মা মাছগুলো সেখানে থাকতে পারে, ব্রিড (প্রজনন) করতে পারে। যেটার বেনিফিট (সুবিধা) স্থানীয়রাই পাচ্ছে। এই মডেলটা দেশের অন্যান্য হাওর-বিলে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।’
- আরো পড়ুন: হাইল হাওরের বাইক্কা বিলে স্বপ্ন বুনন
লছিধারা খাল খননে প্রাণ ফিরেছে বিন্নার হাওরে
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বিন্নার হাওরে অবস্থিত- লছিধারা খাল। দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে ফসলের জমি অনাবাদী হয়ে পড়ে, মাছের উৎসক্ষেত্রও নষ্ট হয়ে যায়। সেই হাওরের চিত্র বদলে দিয়েছেন স্থানীয় যুব উদ্যোক্তারা। সাংবাদিক ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ২০২২ সালে শুকনো মৌসুমে দখলমুক্ত করে সরকারি খালটি খনন করেন।

লছিধারা খাল খননে প্রাণ ফিরেছে বিন্নার হাওরে। ছবি- হাসানাত কামাল
উদ্যোক্তাদের একজন জাহেদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এখন লছিধারা খাল জলাধারে পরিণত হয়েছে। পানির রিজার্ভার তৈরি হয়েছে। কোদালিছড়ার সাথে সরাসরি যুক্ত হয়েছে। সেচের জন্য পানি পাওয়া হচ্ছে। এক ফসলের মাঠ তিন বা চার ফসলে রূপ নিয়েছে। উচ্চফলনশীল জাতের ধানের পাশাপাশি স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী বিন্নি, ময়নাশাইল ইত্যাদি ধান উৎপাদন হয়। রবিশস্য, শাকসব্জি, গম-ভুট্টা ফলে। ফিরে এসেছে ৫০ বছরের আগের সেই কই, শিং, মাগুর, টেংরা; প্রাকৃতিক মাছের উৎস। লছিধারায় পশুপাখি আর উদ্ভিদবৈচিত্র্যের মেলা বসে। এই কৃষি মাঠের টানে হাওরে আসছেন শিক্ষিত-তরুণ কৃষক ও প্রবাসী উদ্যোক্তারা।
আথানগিরি হাওরে স্বেচ্ছাশ্রমে পথ সংস্কার
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আথানগিরি গ্রামের তরুণ জাকারিয়া আহমদ শাহী। তিনি জানান, তাদের গ্রামে প্রায় ৭-৮ হাজার মানুষের বসবাস, যাদের ৯৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর। কিন্তু সংস্কারের অভাবে হাওরে যাতায়াতের পথ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সরকারি উদ্যোগ বা তহবিলও মিলছিলো না। এ অবস্থায় গ্রামবাসি মিলে প্রায় দেড়লাখ টাকা খরচ করে সেই যাতায়াত পথ অনেক সংস্কার করেন। অনেকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। এটা আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ। আমরা এভাবে আমাদের হাওর, বিল, খাল, জলাশয় সংস্কার করে থাকি। পানি সংরক্ষণের জন্য কয়েক বছর আগে গ্রামবাসি স্বেচ্ছাশ্রমে ফোলা নদীর কিছু খনন করেছিলেন। যা শুকনো মৌসুমে ধানের জমিতে সেচ ও গরুসহ পশুপাখির পানি পানের কাজে লাগছে।
গ্রামের মানুষের জন্য উন্মুক্ত পুকুর
আথানগিরি গ্রামের জাকারিয়া আহমদ শাহী বলেন, ‘দেশে পুকুর, জলাশয় কমে যাচ্ছে। এখন পুকুর ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণের একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। এতে জনসাধারণের গোসল এবং পশুপাখির পানি পানের জলাধার কমে যাচ্ছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা সাধারণ মানুষের জন্য পুকুরের ব্যবস্থা করেছিলেন। যেখানে অন্যরা পুকুর ভরাট করে নিচ্ছে, সেখানে আমরা ৬-৭টি পরিবার মিলে সংস্কার করে দিয়েছি। শাহী বলেন, ‘সব পুকুর ভরাট হয়ে গেলে গ্রামের মানুষ কোথায় যাবে? গোসল, গৃহস্থালী কাজ আর পশুপাখির জন্যও তো পানির দরকার আছে।’
সামাজিক আন্দোলনে কোদালিছড়ায় ফিরে আসা পানি প্রবাহ
মৌলভীবাজার জেলা শহরের পানি নিস্কাশনের একমাত্র জলাধার কোদালিছড়া। একটা সময় সংস্কারের অভাবে খালটি সরু হয়ে পড়ে। প্লাস্টিক-পলিথিন আর শহরের বর্জ্যে খালটি ভাগাড়ে পরিণত হয়। সেই আবর্জনা গিয়ে পড়তো হাইল হাওর ও গোপলা নদীতে। একটু বৃষ্টি হলেই শহরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিতো।

কোদালিছড়ার আগের চিত্র। ছবি- হাসানাত কামাল

কোদালিছড়া সংস্কারে শহরে আর জলাবদ্ধতা হয় না। ছবি- মো.মোস্তফা
তরুণ নারী সমাজকর্মী ডোরা প্রেন্টিস বলেন, ‘কোদালিছড়া সংস্কার ছিলো শহরবাসির জন্য বহু আকাঙ্খিত স্বপ্ন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের দশকের পর দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একপর্যায়ে তরুণরা মিলে ‘গড়ব স্বপ্নের শহর’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে ক্যাম্পেইন শুরু করি। গড়ে তুলি সামাজিক আন্দোলন। উদ্যোগ নেয় মৌলভীবাজার পৌরসভা। জেলার প্রায় সকল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মী- সকলে এগিয়ে আসেন। ২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি স্বেচ্ছাশ্রমে কোদালিছড়া খনন কাজের মহাযজ্ঞ শুরু হয়। পরবর্তীতে পৌরসভা কোদালিছড়া সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ এগিয়ে নেয়। এখন কোদালিছড়ায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ হয়। বর্ষায় নৌকা চলে। শহরে জলাবদ্ধতা হয়না। অভিশাপে পরিণত হওয়া কোদালিছড়া আশির্বাদে রূপ নিয়েছে।’
স্থানীয়রা মনে করেন, কোদালিছড়ার এই পুনরুদ্ধার প্রমাণ করেছে সামাজিক উদ্যোগ ও জনসম্পৃক্ততা থাকলে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব।
হাওরপাড়ের গ্রামে পাখি বাড়ি
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মল্লিকসরাই গ্রামের মুজাহিদ আলীর বাড়ি একটি পাখি বাড়ি। চারিদিকে বাঁশঝাড় আর গাছে-গাছে সাদা বক, আবার কোথাও পানকৌড়ি- হাজারো পাখির নিরাপদ আবাস।
মুজাহিদ আলী বলেন, ‘এরা আমাদের অতিথি। সারা বছর ধরেই থাকে। কেউ যেন শিকার না করে, আমরা বাড়ির সবাই চোখে চোখে রাখি। পাখির মলমূত্রে গাছপালা ও ঘরের চাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটাকে আমরা সমস্যা মনে করি না।’
মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে প্রায় তিন বছর কাজ করেছেন রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জেলার হাওর অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে এরকম বেশকিছু পাখিবাড়ি আছে। যেখানে পাখিরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে থাকে। আমি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে দেখেছি, মানুষের মধ্যে অনেক সচেতনা বেড়েছে, বন্যপ্রাণীদের বন্ধু ভাবে।’

কাউয়াদীঘি হাওর অধ্যুষিত মল্লিকসরাই গ্রামে মুজাহিদ আলীর বাড়িতে আশ্রয়ন নিয়েছে সাদাবকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। ছবি- মো. মোস্তফা
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বড়লেখার হাল্লা গ্রামের মনোহর মাস্টারের পাখিবাড়ি, সদর উপজেলার কাগাবলার আতাউর রহমানের পাখিবাড়ি, বিরইমাবাদ গ্রামের নুরুল ইসলাম পঙ্কি মিয়ার বাড়িসহ জেলার ৮-১০টি বাড়ি হাজারো পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। যেখানে অনেক পাখি বাসা তৈরি করে এবং ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায়।
হাওর রক্ষায় শিল্পায়ন ঠেকাতে সামাজিক আন্দোলন
মৌলভীবাজারের হাওরে সোলার প্যানেল প্রকল্প করছে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এতে হাওরের জলাভূমি ক্ষতির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় কৃষক ও পরিবেশ কর্মীরা। এই অপরিকল্পিত শিল্পায়নের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। পাশাপাশি নিয়মিত মানববন্ধন করছে ‘হাওর রক্ষা আন্দোলন, মৌলভীবাজার’ নামে সামাজিক সংগঠন।
সংগঠনের সদস্য সচিব এম খছরু চৌধুরী বলেন, ‘যা জেনেছি, কাউয়াদিঘীতে ৯০০ একর, হাইল হাওরে ৩০০ একর, সিকরাইলে ১০০ একর এবং বড় হাওরের আথানগিরি অংশে পূবের হাওরে সোলার প্যানেল প্রকল্প করা হয়েছে। কিন্তু হাওরের জমি প্রকল্পের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ক্রয়/দখল করা হয়েছে। হাওর বিশেষজ্ঞদের মতামত ছাড়া হাওরের যেকোনো অংশে সৌরবিদ্যুত প্রকল্প আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের শামিল।’ তিনি জানান, হাওর রক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় যুবকেরা
বাংলাদেশের জলাভূমি প্রাণবৈচিত্র্যের এক অপূর্ব সম্ভার বলে মনে করেন পরিবেশ কর্মী ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মীরা। তবে প্রায়ই লোকালয়ে সাপসহ বন্যপ্রাণী বেরিয়ে বিপাকে পড়ে আহত বা মারা যাওয়ার খবর আসে সংবাদ মাধ্যমে। এসব বন্যপ্রাণী উদ্ধারে তৈরি হয়েছে সামাজিক সচেতনতা। Stand for Our Endangered Wildlife (SEW) নামে এমনই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি করেছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার যুবকেরা। তাঁরা সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন জলাভূমি, বনাঞ্চল ও লোকালয়ে বিপন্ন পাখি, সাপ ও বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও সেবা পরবর্তী অবমুক্ত করার কাজ করেন।

সাপ উদ্ধার করছেন সিউ কো-ফাউন্ডার খোকন থৌনাউজাম ও সোহেল শ্যাম। ছবি- আই নিউজ
সংগঠনের অন্যতম ফাউন্ডার সোহেল শ্যাম বলেন, ‘আমরা এই সংগঠন থেকে গত আট বছরে এক হাজারের অধিক পাখি, সাপ ও বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে, প্রয়োজনীয় সেবাশুশ্রুষা দিয়ে অবমুক্ত করেছি। এর মধ্যে আছে চিতাবিড়াল, লজ্জাবতী বানর, বনরুই, অজগর, পেঁচা, বহুরুপি ঈগল ইত্যাদি।
সোহেল শ্যাম বলেন, ‘আমরা সচেতনতার কাজও করি। সবকিছু করছি নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে।’ পরিবেশ কর্মীরা মনে করেন, সচেতন যুবকদের কাজ দেখাচ্ছে কিভাবে স্থানীয় উদ্যোগেই প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা সম্ভব।
নারীর ভূমিকা
কৃষিকাজের মূল সূত্র তৈরি হয় ঘর থেকে, এর সবই নারীরা করেন। এখন নারীরা সরাসরি মাঠে চলে যান। - সজল কান্তি সরকার
হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার বলেন, পুরুষরা টিকেই থাকে নারীর শ্রম দ্বারা। শুধু রোপণ করলেই ধান হয় না। ধান ও রবিশস্যের বীজ তৈরি করা, বীজতলা তৈরির প্রক্রিয়া, পরিকল্পনা, সাহস দেওয়া, টাইমিং, তাগাদা দেওয়া, গরু বের করার তাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজ সবই করেন নারীরা।
সুনামগঞ্জের হাওর জনপদে বেড়ে ওঠা এই গবেষক বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা আগে যেমন সরাসরি মাঠে কাজ করতেন, এখনও তাই করেন। খড় শুকানো, ধান শুকানো, ধান সেদ্ধ দেওয়া সবই তারা করেন। প্রান্তিক জনপদে রবিশস্য নারীরাই করেন। বুনো বীজ সংগ্রহ করে কৃষির শুরু নারীরাই করেছিলেন। কৃষির শ্রষ্ঠা নারীরাই, এখনও তারাই আছেন।

সিলেটের হাওরাঞ্চলে ধান ও খড় শুকাতে ব্যস্ত নারীরা। ছবি- হাসানাত কামাল
অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, জলাভূমির ক্ষেত্রে নারীদের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। মাছটা হয়তো ধরেন পুরুষ লোক। কিন্তু, মাছ কাটা থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বাকি সবকিছুই তো আমাদের নারীরা করে থাকেন।
হাওরকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার বলেন- সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর এলাকায় কিছু আদিবাসি জনগোষ্ঠী এখনও আছে, যাদের জীবন-জীবিকা হাওর কেন্দ্রিক। এদের মধ্যে গারো, হাজং, বানাই ও কোচ সম্প্রদায় রয়েছে। এক সময় কুকি-নাগা কুকি সম্প্রদায় ছিলো, এখন আর নেই। তারা শিকার করে খেতো। এক সময় বেদে সম্প্রদায় ছিলো, এখন তারাও নেই। তাছাড়া মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ অঞ্চলে মণিপুরি সম্প্রদায় আছে। যারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
সজল কান্তি সরকার বলেন- এসব জাতিগোষ্ঠী ধান চাষ, রবিশস্য উৎপাদন ও মাছ ধরার কাজ করেন। এক সময় এসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাঁশের শলা ও বেত দিয়ে তৈরি মাছ ধরার উপকরণ ছাই, পারন, ডরি, পলো বানাতেন। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে কৃষি উপকরণ- টুকরি, লাঙ্গল, জোয়াল ইত্যাদি তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন কৃষি যান্ত্রিকরণ হওয়ায় এই উপকরণগুলোর চাহিদা নেই। এই অঞ্চলে ৪০-৪২ জাতের বাঁশ পাওয়া যায়। আগে বাঁশ-ছনের ঘর হতো। বাঁশ দিয়ে অনেক উপকরণ হতো। এখন পাকা ঘর হওয়ায় সেই চাহিদা কমে গেছে।
বাংলাদেশে ধান ও মাছ চাষে অভূতপূর্ব সাফল্য, জলাভূমি রক্ষায় শঙ্কা
বাংলাদেশে মাছ ও ধান উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী মাছ ও ধান উৎপাদনে উদ্বৃত্ত খাদ্য ভাণ্ডার। অথচ জলাভূমিগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে; কমছে কৃষি জমি, বাড়ছে জনসংখ্যা, তৈরি হচ্ছে বসতি। তবে পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন- মাছ চাষের এই সাফল্যের আড়ালে হাওরের মূল চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে!
জমি কমলেও বাংলাদেশে বেড়েছে ধান উৎপাদন

জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব
জিআইএস স্যাটেলাইট মনিটরিং বা তথ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জলাভূমি ব্যবস্থাপনা উন্নত করা সম্ভব বলে মনে করেন জলাভূমি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান। তিনি বলেন, ‘স্যাটেলাইট ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের হাওর-বিলের মৌসুমভিত্তিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। কোথাও দখল হচ্ছে কি-না, সেটাও মনিটর করতে পারি। এমনকি আরো উন্নত প্রযুক্তি আছে, পানির কোয়ালিটি মনিটর করতে পারি। ড্রোন ব্যবহার করে পেট্রোল করা যেতে পারে। সেখানে কেউ অবৈধভাবে মাছ ধরছে কি-না, জেলেদের নৌকা ঢুকছে কি-না, এগুলো খুব সহজেই মনিটর করা সম্ভব।’
‘বনবিভাগ বা জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে কিছু প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু জলাভূমিতে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না, এটা অবশ্যই করা উচিত।’
জলাভূমির সম্ভাবনা
বাংলাদেশের জলাভূমি রক্ষা করা খুবই সহজ বলে মনে করেন হাওর গবেষক সজল কান্তি সরকার। তিনি বলেন, ‘জলাভূমির প্রাণ বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির পানি এখনও নষ্ট হয়নি। হাওরকে টিকিয়ে রাখার সাইকেল হচ্ছে পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টি পানি, ঝরণা এবং নদী। সেটাকে ইচ্ছা করলেই আমরা টিকিয়ে রাখতে পারি। কারণ এখন যন্ত্র দিয়ে খুব সহজে হাওর, বিল, নদী, খনন করতে পারি।’
জলাভূমি রক্ষায় স্থানীয় জেলে, কৃষক, পরিবেশ কর্মী, সাংবাদিক, জলাভূমি বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা যে পরামর্শ দিয়েছেন:
করণীয়-
• জলাভূমি খনন ও নাব্যতা রক্ষা করা
• হাওরের চরিত্র পরিবর্তন না করা
• স্থানীয় জেলে ও কৃষকদের সম্পৃক্ত করে অভয়াশ্রম তৈরি করা
• বিল ইজারা দেওয়া বন্ধ করা
• প্রজনন মৌসুমে নির্দিষ্ট সময়ে মা ও পোনা মাছ নিধনে কঠোর আইন প্রয়োগ
• মাছ ধরা নিষিদ্ধকালীন সময়ে জেলেদের প্রণোদনা প্রদান
• জিপিএস মনিটরিং ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার
• হাওরে উঁচু বেরি বাঁধ দেওয়া বন্ধ করা
• জলজ উদ্ভিদ-বৃক্ষ বাঁচানোর কর্মসূচি হাতে নেওয়া
• জলজ উদ্ভিদ নার্সারী করা
• জলাভূমি রক্ষায় কৃষি বীমা চালু করা
• হাওর গবেষণা কেন্দ্র করা
• ক্ষতিকারক বালাইনাশক ব্যবহার বন্ধ করা
• মরমী ধারা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা
• ইকো-ট্যুরিজম বাস্তবায়ন

হাওর মহাপরিকল্পনা
সংকট, করণীয় ও পরিকল্পনা বিষয়ে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর জানায়, হাওর অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ ও জলাভূমি ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে খসড়া মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি জনসাধারণের মতামত ও পরামর্শের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। যে কেউ এই মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে মতামত জানাতে পারবেন।
তবে এ বিষয়ে জলাভূমি গবেষক সজল কান্তি সরকার বলেন, ‘এটা মহাপরিকল্পনার কিছুই হয়নি। অনেক ত্রুটি আছে। আমরা এটা নিয়ে বসবো। এখানে কি সংযোজন-বিয়োজন করা যায়, সে পরামর্শ দেবো। আমাদের কথা রাখতে পারে, নাও পারে।’
শেষ কথা
বাংলাদেশে জলাভূমির গভীর সংকটের মধ্যে আশা দেখাচ্ছে- বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম, স্বেচ্ছাশ্রমে লছিধারা খাল খনন, কোদালিছড়া সংস্কার, পাখিবাড়ির মতো উদ্যোগগুলো। কমিউনিটির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে সারাদেশে তা ছড়িয়ে দেওয়া এবং কিছু জলাভূমি রক্ষিত ঘোষণা করার তাগাদা জলাভূমি বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং স্যাটেলাইট ম্যাপিং ও জিআইএসের মতো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার জলাভূমি রক্ষায় নতুন পথ দেখাবে বলে করেন সংশ্লিষ্টরা।
Read the story in English: Wetlands Under Threat in Bangladesh – Initiatives to Protect
আরো পড়ুন:
-
‘হাওরকে ঢাকা শহর করতে চাইলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে’ - সজল কান্তি সরকারের সাক্ষাৎকার
-
জলাভূমি রক্ষায় অভয়াশ্রম স্থাপনই টেকসই সমাধান - অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানের সাক্ষাৎকার
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- বেইলি রোডে আগুন : ৩ জন আটক
- এই নৌকা নূহ নবীর নৌকা: সিলেটে প্রধানমন্ত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
























