Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০২ অক্টোবর ২০২৫,   আশ্বিন ১৬ ১৪৩২

ডেস্ক নিউজ

প্রকাশিত: ১১:২১, ১০ আগস্ট ২০২০

ঘুষের টাকা সরাতে ব্যস্ত প্রদীপের সহযোগীরা

মাদক কারবারিদের ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ও আত্মসমর্পণ করানোর নামে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন টেকনাফ সদর থানার সদ্য সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সহযোগীরা। এরই মধ্যে প্রদীপের দেহরক্ষী কনস্টেবল রুবেল শর্মার স্ত্রী লক্ষ্মী শর্মা ব্যাগের ভেতরে করে টাকা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। গত শনিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ রোডের একটি চেকপোস্টে তিনি ধরা পড়েন বলে জানতে পেরেছে  দেশ রূপান্তর এবং এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন  তৈরী করেছে। তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।  আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাটি জেনেও চুপ রয়েছেন। রুবেল শর্মার মতো প্রদীপের অন্য সহযোগীরাও তাদের অবৈধ আয়ের টাকা সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এদিকে প্রদীপ ও তার সহযোগীদের সহায়তাকারী কয়েকজন স্থানীয় সাংবাদিককে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। তার মধ্যে এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার থেকে বাঁচানো ও আত্মসমর্পণের নামে এক মাদক কারবারির পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

প্রদীপের সহযোগীদের আয়ের উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মাঠে নেমেছে। বিশেষ করে টেকনাফ সদর থানায় কর্মরত সব পুলিশ সদস্যের বায়োডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। সাবেক মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় তার বোন মামলা করার পর এখন অনেক ভুক্তভোগী মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গতকাল টেকনাফের বাহারছড়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোছাম্মৎ রেহেনা আক্তার তার স্বামীকে ক্রসফায়ার দেওয়ার ঘটনায় প্রদীপসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করতে আদালতে যান। তবে সময়ের অভাবে মামলা করতে পারেননি। আজ সোমবার তিনি মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন রেহেনার ভাশুর মোহাম্মদ হানিফ।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, কক্সবাজারের টেকনাফে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। সিনহার বোন বাদী হয়ে ওসি প্রদীপসহ ৯ পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেন আদালতে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রদীপসহ সাতজনকে। তবে এজাহারে থাকা দুই আসামির নাম নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। জেলা পুলিশ বলছে ওইসব নামে পুলিশের কোনো সদস্য নেই। তারপরও তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশের আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার সহযোগীদের ব্যাপারে টেকনাফের লোকজন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। অনেক ভুক্তভোগী মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত দুই বছরে ওসি প্রদীপ টেকনাফসহ আশপাশ এলাকায় মাদক কারবারিদের নির্মূলের নামে নিরপরাধ লোকদের নানাভাবে হয়রানি করেছেন। বিশেষ করে ক্রসফায়ারের নামে ওসি ও তার সহযোগীরা মোটা অঙ্কের অর্থ কামিয়েছেন। তাছাড়া মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণের নামে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রদীপের সহযোগীরা। আর এসব কাজে প্রদীপকে সহায়তা করেছেন স্থানীয় রাজনীতিবিদ, কমিউনিটি পুলিশের নেতা ও সাংবাদিকরা। প্রদীপের অপকর্মের বিষয়টি জেলা পুলিশ, চট্টগ্রাম রেঞ্জ অফিস ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আঁচ করতে পেরেও তার প্রভাবের কারণে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। যার ফলে প্রদীপের সহযোগীরা বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সাবেক মেজর সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় ফেঁসে যান প্রদীপ ও তার কিছু সহযোগী। তবে এখনো বহাল আছেন প্রদীপের অন্য সহযোগীরা। তবে তারা অবৈধভাবে আয় করা তাদের অর্থ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এখন ওই অর্থ তারা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

কক্সবাজার পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়ার শিলখালী চেকপোস্টে একটি মাইক্রোবাসকে সন্দেহ হলে সেটি আটক করেন দায়িত্বরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। পরে তল্লাশির মাধ্যমে ওই মাইক্রোবাসে থাকা একটি লাগেজ তল্লাশি করতে চাইলে এক নারী প্রথমে তা দেখাতে অস্বীকৃতি জানান। পরে তিনি লাগেজ খুলতে বাধ্য হন। লাগেজ থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে ওই মহিলা পুলিশ সদস্যর স্ত্রী পরিচয় দেন। তার স্বামী টেকনাফ মডেল থানা পুলিশের কনস্টেবল রুবেল শর্মা। আর ওই মহিলা রুবেলের স্ত্রী লক্ষ্মী শর্মা। তারা কক্সবাজারে পুলিশ লাইনে যান। এত টাকা কোথায় থেকে এলো তা জানতে চান দায়িত্বরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। চিকিৎসার খরচ টাকার কথা বলার পর মানবিক কারণ দেখিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ থানার এক সদস্য জানান, নিরপরাধ লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকাগুলো সরানোর চেষ্টা করছে। রুবেল শর্মা ছিল ওসি প্রদীপের ডান হাত। বেশিরভাগ ক্রসফায়ার তার মাধ্যমে হয়েছে। প্রদীপ ও তার সিন্ডিকেট সদস্যরা ব্যাংকে টাকা কম রাখতেন। থানার ভেতর বা ব্যারাকে রাখতেন অর্থগুলো। আবার কেউ কেউ টেকনাফ শহরে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। থানার ওই সদস্য আরও জানান, ছয় মাস আগে টেকনাফ থানায় যোগ দিই। নিজ চোখে দেখেছি প্রদীপ স্যার ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। রুবেলের স্ত্রীর সঙ্গে আরেক কনস্টেবল সাগর দেবও ছিলেন। বিষয়টি জেলার বড় স্যারেরা জানেন।

এ প্রসঙ্গে জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা  বলেন, বিষয়টি আমরা জেনেছি। রুবেল শর্মার স্ত্রী কক্সবাজারে আছেন। রুবেল ও সাগর দেবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এত টাকা তারা কোথায় পেয়েছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রদীপের সঙ্গে যারা অপকর্ম চালিয়েছিলেন তাদের কাউকে রক্ষা করা হবে না। তাদের প্রতিটি বিষয় আমরা খোঁজ নিচ্ছি। তারা টাকা-পয়সা সরানোর চেষ্টা করছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি।

একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা  বলেন, টেকনাফ থানা কর্মরত প্রতিটি সদস্যের পুরো প্রোফাইল সংগ্রহ করা হচ্ছে। হাতিয়ে নেওয়া অর্থগুলো কোথায় আছে তা বের করার চেষ্টা চলছে। এমনকি তাদের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ওসি প্রদীপ ছিলেন বেশি বেপরোয়া। তিনি কাউকে পাত্তা দিতেন না। রেঞ্জ ডিআইজি বা জেলার এসপির কথাও নাকি তিনি শুনতেন না। তার উত্থান ২০১২ সাল থেকে। ওই সময় পতেঙ্গা থানার ওসি থাকাকালে বিতর্কের জন্ম দেন তিনি। ওই বছর চট্টগ্রাম বন্দরে একটি বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা, বার্জ আটক এবং বার্জমালিকসহ ১৮ জনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দিয়ে হয়রানি করার পাশাপাশি অনৈতিক সুবিধাও নিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তাকে পতেঙ্গা থানা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে প্রদীপ পাঁচলাইশ এবং বায়েজিদ বোস্তামী থানার দায়িত্ব পালনকালে নিরপরাধ লোকদের হয়রানি করে টাকা কামান। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ২০১৩ সালে জোহরের নামাজের সময় পাঁচলাইশ থানা এলাকার একটি মসজিদে জুতা পায়ে প্রবেশ করা নিয়ে বেশ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। এই রকম অসংখ্য অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। প্রতিটি বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি। তাছাড়া কথিত কয়েকজন সাংবাদিককে নজরদারি করা হচ্ছে। এর মধ্যে এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে। ওই সাংবাদিক আত্মসমর্পণের নামে প্রদীপ সিন্ডিকেটের পাশাপাশি নিজেও অর্থ কামাই করেছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি।

মিথ্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিককে হয়রানি : ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফাকে আটক করে টেকনাফ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালান প্রদীপ। তার চোখে মরিচের গুঁড়া দিয়ে নির্যাতন করায় বর্তমানে দুটি চোখই নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এছাড়া তার হাত-পা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে ইয়াবা কারবারি সাজিয়ে মামলা ঠুকে মোস্তফাকে কারাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন ওসি প্রদীপ। স্থানীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, পুলিশের নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সংবাদ প্রকাশের জেরে ‘কক্সবাজার বাণী’ পত্রিকার সম্পাদক মোস্তফাকে ফাঁসানো হয়। তার স্ত্রী হাসিনা আক্তারও জানান, তার স্বামী বিভিন্ন সময় টেকনাফ থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করেছেন।

থানায় মামলা করতে আদালতে ভুক্তভোগী : গতকাল টেকনাফের বাহারছড়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ হানিফ কক্সবাজার আদালতে যান। কিন্তু সময়ের অভাবে তিনি মামলা করতে পারেননি। তবে আজ (সোমবার) মামলা করবেন বলে জানান হানিফ। তিনি বলেন, গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে তার ছোট ভাই আবদুস সালামকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে ওসি ক্যাশিয়ার জামশেদ ও এসআই জহির তাদের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে পারব না বলে জানিয়ে দিলে তাকে মাদক কারবারি সাজায় পুলিশ। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে ক্রসফায়ার দিয়ে মেরে ফেলা হয়। ক্রসফায়ারের ঘটনায় আমার ভাগনি নাসিমাকে আসামি করা হয়। তিনি আরও বলেন, সালাম মাছ ব্যবসা করতেন। প্রদীপের ভয়ে আমরা কথা বলতে পারতাম না। প্রদীপ, এসআই হাবিব, ক্যাশিয়ার জামশেদ ও এসআই জহিরকে আসামি করে মামলা করব।

Green Tea
সারাবাংলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়