Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বুধবার   ০১ অক্টোবর ২০২৫,   আশ্বিন ১৬ ১৪৩২

রিপন দে

প্রকাশিত: ২২:৫৪, ৩১ আগস্ট ২০২০

শেষ হওয়ার পথে “সাদা সোনা” খ্যাত রাবার শিল্প

রাবার গাছের থেকে যে সাদা কষ বের হয় মূলত তাই রাবারের মূল উপাদান। রাবারের এই কষকে বলা হত সাদা সোনা। ৮০ দশকে সরকার থেকে রাবার উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ প্রদান করা হয়। তখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে অনেকগুলো রাবার বাগান। কর্মসংস্থান হয় কয়েক হাজার বেকারের। 

বিশেষ করে মৌলভীবাজার অঞ্চলের চা শিল্পের চেয়ে রাবার উৎপাদনে শ্রম ও খরচ ৭৫% কম হওয়ায় দিনে দিনে রাবারের চাষের দিকে ঝোঁক বাড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরের ব্যবধানে রাবারের দাম কয়েকগুণ কমে যাওয়া এবং বিদেশ থেকে রাবার আমদানির ফলে আগ্রহ হারিয়েছেন রাবার বাগানের মালিকরা। ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাবার বাগান যা এই শিল্পকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।  

বাগান মালিকরা বলছেন এই শিল্প নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না থাকা, সনাতন চাষ পদ্ধতি, নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়া এবং সরকারের উদাসীনতার কারণেও রাবার শিল্প তার সুদিন হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মহাসঙ্কটে পরবে এই খাত। ইতিমধ্যে অনেক উদ্যোক্তা বাগান বিক্রি করে দিয়েছেন, অনেকে বিক্রির কথা ভাবছেন ।   

রাবার বাগানের মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৮০ দশকে বাগান শুরু করার পর ৯০ সালের দিকে প্রতি কেজি রাবারের কষ ২৮০ টাকায় বিক্রি হলেও তা কমতে কমতে বর্তমানে ১০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে এবং এক লিটারে ২৫ টাকা (প্রতি ৪ লিটার রাবারের কষ থেকে ১ কেজি রাবার হয়) ১৫ বছরে রাবারের দাম কমে আসলেও শ্রমিকসহ সব কিছু মূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ। এক কেজি রাবার উৎপাদনে খরচ হয় ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। সাথে আছে ১৫% ভ্যাট। সব মিলিয়ে এই ব্যবসায় এখন লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি।

কুলাউড়া উপজেলার কলিমউল্লা রাবার বাগানের সত্ত্বাধিকারী টিপু চৌধুরী জানান, এক কেজি রাবার উৎপাদনে খরচ হয় ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। সাথে আছে ১৫% ভ্যাট কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা লিটার। তাই রাবার বাগান করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন সব বাগান মালিক। 

একই উপজেলার সুইট খান জানালেন, তার দুটি রাবার বাগান ছিল, তিন বছর আগে একটি বাগান বিক্রি করে দিয়েছেন। করোনার কারণে ক্রেতা না থাকায় অন্য বাগানেরও কষ সংগ্রহ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তিনি এরই মধ্যে অবশিষ্ট বাগানটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ৯০ সালে আমি বাগান শুরু করি। তখন ২৮০ টাকায় প্রতি কেজি রাবার বিক্রি করেছি। কিন্ত গত ১৫ বছর ধরে রাবারের দাম এত কমছে যে বর্তমানে প্রতি লিটার রাবারের কষ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। চার লিটার কষে এক কেজি রাবার হয়। এক কেজি রাবার বিক্রি করে দাম পাচ্ছি ১০০ টাকা। অথচ এক কেজি উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। তার উপর আছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। তাই এই ব্যবসায়ে এখন লোকসানই দেখা দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে সরকারি রাবার বাগান ১৮টি। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জোনে নয়টি, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জোনে পাঁচটি, সিলেট জোনে চারটি বাগান রয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে প্রায় ৭০ হাজার একর ভূমিতে রাবার চাষ হয়। দেশে বছরে ১৬ থেকে ২০ হাজার টন রাবার উৎপাদন হয়। আর দেশীয় বাজারে এই পণ্যের চাহিদা বছরে ৩০ হাজার টন।

৩০ হাজার টন চাহিদা থাকলেও দেশের বাজারে দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে রাবার বাগানের মালিকরা জানালেন, বিদেশ থেকে রাবার আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত রাবারের দাম কমে গেছে। এ ছাড়া রাবার কৃষি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও শিল্প পণ্য হিসেবে দেশের বাজারে ভ্যাট দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। এ কারণে আরও বিপাকে পড়েছেন বাগানের উদ্যোক্তারা।

লোকসান গুনছে সরকারি বাগানগুলোও। বেসরকারি কয়েকটি রাবার বাগানের মালিকরা জানান, ২০১০-১২ সালে রাবারের দাম ছিল কেজি প্রতি ২৮০-৩২০ টাকা, ২০১৩-২০১৪ সালে এসে দাঁড়ায় ১২০-১৩০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি রাবার ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সিলেট অঞ্চলে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ভাটেরা, সাতগাঁও শাহজী বাজার ও রূপাইছড়া বাগানে মোট আট হাজার ৪৪২ একর জমিতে রাবার চাষ হয়। এ ছাড়া এই অঞ্চলে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শতাধিক রাবার বাগান রয়েছে। রাবার বাগানের কষের দাম কমে যাওয়ায় বাগান মালিকরা গাছ কেটে ফেলছেন ।

কুলাউড়া উপজেলার রাবার বাগান মালিক আবদুল মতলিব। তিনি বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ভর্তুকি দিয়ে বাগান চালু রেখেছিলাম। দাম বাড়ার আশায় ছিলাম। কিন্তু দিন দিন দাম কমছেই। ফলে পুঁজি হারিয়ে সংকটে পড়েছিলাম। এ কারণে সব গাছ কেটে বিক্রি করে ফেলেছি। 

এ ছাড়াও এই অঞ্চলের বনবিভাগও রাবারের জন্য নতুন জমি দিতে আগ্রহী নয় এবং সরকারি বাগানগুলোর এক লাখ ৩২ হাজার রাবার গাছের জীবনচক্র এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আয়ুষ্কাল হারানো গাছগুলোকে শ্রীমঙ্গলে রাবার কাট প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে নিয়ে ফার্নিচার তৈরির উপযোগি করা হচ্ছে।

ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জেনারেল ম্যানেজার জামিল আক্তার বকুল বলেন, রাবার গাছ সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে দারুণ টেকসই হয়। যা সেগুন কাঠের মতো আসবাব শিল্পে ব্যবহার করা যায়। গত বছর ১ লাখ ঘনফুট কাঠ তারা ট্রিটমেন্ট করেছেন যার বাজার মূল্য ৫ কোটি। সব খরচ বাদ দিয়ে সরকারের ১ কোটি টাকা লাভ হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ২ মাস কাজ চললেও বর্তমানে করোনার কারণে তা বন্ধ আছে।  

সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বাশিউক) রাবার বিভাগ, সিলেট অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ওয়ালিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে জানান, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সাংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলা যাবেনা। আগে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পরে কথা বলবেন। পরের দিন এই ব্যপারে যোগাযোগ করলে কথা বলেন কিন্তু পরপর ২ দিন ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি কোন তথ্য দেননি। 

উল্লেখ্য, রাবার দিয়ে যানবাহনের টিউব-টায়ার, জুতা, স্যান্ডেল, হোসপাইপ, বাকেট, গ্যাসকেট, ওয়েলসিল, অটোমোবাইল পার্টস, টেক্সটাইল জুট, স্পেয়ার্স ইত্যাদি পণ্য তৈরী হয়। যার কারণে এর চাহিদাও রয়েছে।

Green Tea
সারাবাংলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়