Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বুধবার   ০১ অক্টোবর ২০২৫,   আশ্বিন ১৬ ১৪৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০২:৫৯, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০

আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকারের ৯৯ তম জন্মদিন আজ

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাঁধে ঝোলাভর্তি বই নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তিনি। মাইলের পর মাইল হেঁটে একেকদিন একেক গ্রামে। বাড়ি বাড়ি কড়া নেড়ে আগের সপ্তাহের বই ফেরত নিয়ে নতুন বই পড়তে দিতেন। কেউ তাকে ডাকতেন ‘বইওয়ালা দাদুভাই’। কেউ আবার ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। 

আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকারের ৯৯ তম জন্মদিন আজ। শুভ জন্মদিন পলান সরকার।

জ্ঞানের এই ফেরিওয়ালা রোজ ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার হেঁটে বিনামূল্যে সবাইকে বই বিলি করতেন। পড়া হলে আবার ফেরত নিয়ে নিতেন। গত বছরের পহেলা মার্চ ৯৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা বাউসা থেকেই প্রায় চল্লিশ বছর ধরে অজ-পাড়াগাঁয়ে এভাবে তিনি নিরবে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে গেছেন তার জীবদ্দশায়।

তাই পলান সরকার নামটি শুনলেই মাথা নত হয়ে আসে। তিনি একাই একটি গণগ্রন্থাগার ছিলেন। তার কর্মে আলোকিত হয়েছে আশপাশের অন্তত ২০ গ্রাম।

আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার

কাঁধে একটি ঝোলাভর্তি বই, চোখে মোটা কাঁচের ঘোলাটে চশমা আর গায়ে সাদামাটা পাঞ্জাবী পরা একজন মানুষ গাঁয়ের কোনো মেঠো রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছেন মাইলের পর মাইল এমন দৃশ্য রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বাউসা গ্রামের মানুষের কাছে ছিল খুব পরিচিত।

মাইলের পর মাইল হেঁটে দূর দুরান্তের গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নেড়ে বই দিতেন তিনি এবং তা আবার সপ্তাহখানেক বাদে ফেরত নিয়ে আসতেন। এভাবে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামে হাজারো মানুষকে তিনি বইয়ের আলোয় আলোকিত করেছেন। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে পলান সরকারের এই বই দেয়া এবং নেয়ার মাধ্যমে সবার মাঝে বই পড়ার আগ্রহ গড়ে তোলার কথা দেশবাসীর নজরে আসে।

তিনি ১৯২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোর জেলার বাগাতি পাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র পাঁচ মাস বয়সে বাবা হায়াত উল্লাহ সরকারের মৃত্যুতে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর অর্থনৈতিক সংকটে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। এরপর তার নানা ময়েন উদ্দিন সরকার মা মইফুন নেসা’সহ পলান সরকারকে রাজশাহীর বাঘার থানার বাউসা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি একটি স্কুলে ভর্তি হন যেখানে ষষ্ঠ শ্রেণীর পর লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন হারেজ উদ্দিন সরকার। তবে জন্মের পর থেকেই মা ‘পলান’ নামে ডাকতেন। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে পলান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস থেকে যায় আজীবন।

যুবক বয়সে যাত্রাদলে স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ করতেন পলান সরকার। মাঝে মাঝে প্রম্পটের কাজ করতেন মঞ্চের পেছনে। আর এই কাজটিই তাঁর বই পড়ার অভ্যাস ধরে রাখে।

১৯৯০ সাল থেকে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তাঁর কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। এরপর গ্রামের মানুষও তাঁর কাছে বই চাইতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত।

সাদাসিধা এই মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে বাউসা হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৬৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর প্রচারবিমুখ পলান সরকার স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। বাউসা বাজারে তাঁর একটি চালকল ও রয়েছে।

১৯৯২ সালে ডায়াবেটিকসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখন তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন। এছাড়া যারা তাঁর চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন। তাঁর কর্মকাণ্ড সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। এলাকার চায়ের দোকানী পর্যন্ত হয়ে ওঠে বই পাগল, প্রতি বিকালে তার দোকানে বসে বই পড়ার আসর। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে।

প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খুব অল্প সংখ্যক মানুষই পলান সরকারের এই অসামান্য শিক্ষা আন্দোলনের গল্প জানতেন। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভি-তে ‘ইত্যাদি’ নামক জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে তাঁকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এরপর দেশের সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে চিনতে পারেন।

পলান সরকার ২০১১ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার উপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক ‘অবদান’। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সকলের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে ‘সাদা মনের মানুষ’ খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ২০১৯ সালের ১ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।

Green Tea
সারাবাংলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়