[caption id="" align="alignnone" width="976"]
মালবী গুপ্ত[/caption]

আই নিউজ ডেস্ক : ভারতের সাংবাদিক
জানতে ইচ্ছে করে, ভারতে আরও কত শত সহস্র শিশুকন্যা ও নারীর ধর্ষণ এবং তারপর তাকে পিটিয়ে, গলা টিপে, অ্যাসিড বা পেট্রল কিম্বা কেরোসিনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা ঘটলে, তবে থামবে এই নারী নিধন-যজ্ঞ?বিবিসির ওই মন্তব্য প্রতিবেদনে বলেন- জানি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর মিলবে না। তাই দ্বিধাহীন বলা যায় - কোনো দিনই থামবে না।
সে যতই দেশ জুড়ে প্রতিবাদে মানুষ রাস্তায় নামুক, মোমবাতি মিছিল হোক, দেশের নেতা-মন্ত্রীরা যতই সংসদের ভেতরে ও বাইরে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের আস্ফালন করুন না কেন, এই নারকীয় হত্যা-প্রবাহ থামবে না।
থামবে না, কারণ থামানোর কোনো মৌলিক চেষ্টা নেই, কোনো উদ্যোগ নেই। থামবে না কারণ, প্রশাসনিক স্তরে থামানোর কোনো মানসিকতাই নেই।
থাকলে, মেয়েদের ধর্ষণ-খুনের রক্তের দাগ প্রায় প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যমে এমন ছিটকে এসে লাগত না। থাকলে, সাত বছর আগের নির্ভয়া হত্যার মতোই গত ২৬শে নভেম্বর হায়দ্রাবাদের তরুণী পশু চিকিৎসককে গণ ধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারা এবং তারপরের কয়েকদিনে বিহার, কর্ণাটক, রাজস্থানে (৬ বছরের শিশুসহ) এবং উন্নাওয়ে ধর্ষণ-খুনের মতো এমন নৃশংসতার অসংখ্য ঘটনা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটে যেত না।
একেবারে শিশু কন্যা থেকে এমনকি বৃদ্ধার ওপরও গণ ধর্ষণ ও নির্যাতনের এমন পৈশাচিক উল্লাসও দেশে দেখা যেত না।
এবং এইসব হত্যার প্রতিবাদে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে 'কেন আমি আমার নিজের ভারতে নিরাপদ নই?' (যা আজ লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নারীরও প্রশ্ন) - এই পোস্টার হাতে নিয়ে নিঃশব্দে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা তরুণী অনু দুবেকে পুলিশেরই হাতে অমন নির্যাতিতও হতে হত না।
এই কথা সত্য যে, সেই স্মরণাতীত কাল থেকেই মেয়েদের প্রতি নানাবিধ হিংসা ঘটে চলেছে, যার মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, দিনে পুলিশে নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যা গড়ে ৯২।
কিন্তু আসল সংখ্যাটি যে এর কতগুণ তা অনুমান করাও বোধহয় কঠিন। এবং এও সত্য যে, ধর্ষণ-খুনের চরম নিষ্ঠুরতার এই দু'চারটি ছাড়া, খুব কম ঘটনাই দেশের আপামর মানুষের ক্রোধকে এমন জাগিয়ে তুলছে।
বস্তুতই, ভারতে নির্ভয়া, কামদুনি, কাঠুয়া, উন্নাও, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি যেন একের পর এক বিভীষিকার নাম হয়ে উঠেছে। এবং কেবলই মনে হচ্ছে আমরা মেয়েরা, সে একেবারে ২-৩ বছরের শিশুই হোক আর ৭০-৭৫ বছরের প্রবীণা - যে নৃশংসতার ঘটমান বর্তমানে সবাই দাঁড়িয়ে - তাতে কেউই আর নিরাপদ নই।
বাড়ির বাইরে বেরুলে কখন মেয়েরা অক্ষত বাড়িতে ফিরবে - সেই ভয় যেন আবার আমাদের অনেককেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
তবে কি জানি, এই চরম নিরাপত্তাহীনতার অদৃশ্য ভয়ই কি অনু দুবেকে সাহসী করে তুলেছে? তাই সে একলাই রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে পেরেছে। সে বলতে পারছে - 'যা করার হয় কর। আজ আর মনে ভয় নেই'।
কিন্তু মনে ভয় যে তাদেরও নেই, যারা দেশের নানা প্রান্তে মেয়েদের প্রতি এই ভয়ঙ্কর হিংসার ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে। তা নাহলে হায়দ্রাবাদের পশু চিকিৎসকের গণ ধর্ষণ ও পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে সারা দেশ যখন গর্জে উঠছে, অপরাধীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবিতে, ঠিক তখনই কর্ণাটক, বিহার, রাজস্থান, কলকাতা, উন্নাও - সর্বত্র প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছে?
আসলে তারা জানেই, যদি তাদের জেলে তথা সংশোধনাগারে যেতেও হয়, তবে সেখানে বেশ খেয়ে-পরে সংশোধিত হওয়ার সুযোগ থাকবে। তারা জানে, বিচার ব্যবস্থা অত গতিশীল নয়।
তাই বছরের পর বছর জেলে বিচারাধীন থাকতে পারবে। চাই কি অপরাধীর জীবদ্দশাতে বিচার কার্যটি অসমাপ্তও থেকে যেতে পারে, যা প্রায়শই ঘটে।
আর কলকাঠি নাড়তে পারলে তো ড্যাঙ ড্যাঙ করে জেলের বাইরে বেরিয়ে আসা কে ঠেকাবে? এবং ততদিনে অপরাধীর জন্য মানুষের ফাঁসির দাবির ক্রোধাগ্নিও নিভে যাবে। সেই বীভৎসতার স্মৃতিও ক্রমশ মুছে যাবে জনতার মন থেকে।
আর এসবই আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও খুব ভাল করে জানা। তাই অনেক সময়ই ঘটনার তদন্ত কাজে তাঁদের মধ্যে তেমন তৎপরতা থাকে না।
অপরাধের প্রমাণপত্র জোগাড় করতে দিনের পর দিন কেটে যায়। কিম্বা কোনো অজ্ঞাত কারণে তাঁরা জোগাড়ই করে উঠতে পারেন না।
এবং তাঁদেরই অসহযোগিতায় হাজার হাজার কেসের সময় মতো মীমাংসাই হয় না । নয়তো উপযুক্ত প্রমাণাভাবে ঘোরতর অপরাধীও ছাড়া পেয়ে যায়।
তাই বোধহয় ভারতে মেয়েদের প্রতি হিংসায় অপরাধীর সাজার ঘটনা অত্যন্ত কম। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) রিপোর্ট বলছে দেশে মেয়েদের প্রতি হিংসা ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৭ তে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। কিন্তু কনভিকশন রেট ২০১৪ এর তুলনায় বেড়েছে মাত্র ৩.৩ শতাংশ।
সংসদে সন্দেহভাজন
আসলে যে দেশের বহু রাজনৈতিক নেতাই মেয়েদের প্রতি অপরাধের রেকর্ড সঙ্গে নিয়েই জনপ্রতিনিধিত্বের আসন অলঙ্কৃত করেন, আর যাই হোক, মেয়েদের নিরাপত্তা বিধানে তাঁদের যে আন্তরিকতা থাকবে না, এটা বলাই বাহুল্য।
না, চমকে উঠবেন না, ভারতের নবনির্বাচিত লোকসভা সদস্যর প্রায় অর্ধেকের বিরুদ্ধেই নাকি 'ক্রিমিনাল চার্জ' রয়েছে। এবং দেখা যাচ্ছে সেই সব কেসের ২৯%ই আবার ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা অথবা মেয়েদের প্রতি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত।
আসলে আমাদের সমাজে মেয়েদের প্রতি সংঘটিত হিংসাকে আজও অপরাধ হিসেবে ততো গুরুত্বই দেওয়া হয় না। তাই সেই অপরাধ প্রমাণের পরিকাঠামো গড়ে তোলায় ফাঁক থেকে যায়। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার অন্যান্য কারণগুলির সমাধানেও তেমন উদ্যোগ দেখা যায় না।
তা নাহলে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ঘটে যাওয়া দিল্লির নৃশংসতম নির্ভয়া হত্যার অপরাধীদের শাস্তিদানের কাজটি আজও অসম্পূর্ণ থেকে যায়?
তাই মনে হচ্ছে, গতবছর 'পৃথিবীতে ভারতই মেয়েদের পক্ষে সবচেয়ে বিপদজনক দেশ' হিসেবে চিহ্নিত মর্যাদার স্থানটি আপাতত অক্ষুণ্ণই থেকে যাচ্ছে।