Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ০৫ জুলাই ২০২৫,   আষাঢ় ২০ ১৪৩২

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১ মে ২০১৯
আপডেট: ১০:৫৭, ১ মে ২০১৯

মান্না দে সঙ্গীতের একটা সভ্যতা: কবীর সুমন

আই নিউজ ডেস্ক: আজ সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র জন্মশতবর্ষ। জন্মদিনে মান্না দে-কে নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন আর এক কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন "মান্না দে সঙ্গীতের একটা সভ্যতা। তিনি বাংলার মানুষ, তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কাছে। শুধু তাঁর কাছে নয়, তাঁর কাছেও। বলা দরকার, কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন একজন বিস্ময়, জিনিয়াস। সেই সঙ্গে একজন অসাধারণ পারফর্মার। কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, বাংলার বিভিন্ন ধরনের ভক্তিগীতি, ভজন, ক্লাসিকাল, সেমি ক্লাসিকালের নানা ধারায় তাঁর অসামান্য অবদান ছিল। শুধু কলকাতার মঞ্চে নন, বম্বের ফিল্মেও কৃষ্ণচন্দ্র দের প্রতিভার সাহায্য নেওয়া হয়েছিল। এ হেন কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন মান্না দে-র নিজের কাকা। এমন কাকার কাছে মানুষ হওয়া ও গান শেখার ফলে মান্না দে-র সঙ্গীতের জগৎটা ছিল বিশাল। সঙ্গীতের এত বড়ো জগৎ ভারতে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ছাড়া আর কারও ছিল না। সঙ্গীতের অন্তত ২০-২৫টা আঙ্গিক মান্না দে-র কাছে ছিল জলভাত! বাংলার বিচিত্র সঙ্গীত, ভক্তিগীতি, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত, কবিগান, ফোক সং, যতরকম আঙ্গিক, সবই তিনি রপ্ত করেছিলেন। অন্যদিকে তিনি দস্তুরমতো খেয়াল গাইতে পারতেন। অসামান্য কাওয়ালি শিল্পীও ছিলেন তিনি। ‘বরসাত কি রাত’ ছবিতে ওঁর গাওয়া কাওয়ালির কোনও তুলনা হয় না। ইতিহাস হয়ে রয়েছে সে গান।
মান্না দে বড়ো গলায়, খোলা গলায় গাইতেন। বম্বেতে নানাধরনের গান গেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে রোমান্টিক গান যেমন আছে, তেমনি সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনায় ‘যানেওয়ালে সিপাহি সে পুছো’র মতো এক অসামান্য, যুদ্ধবিরোধী গানও আছে। ‘কাবলিওলা’ ছবিেত ‘অ্যায় মেরে পেয়ারে ওতন’ মান্না দে-র অসাধারণ একটি কাজ! তা ছাড়া অনেক মজার গানেও মান্না দে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তিনিই বোধহয় বোম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সবচেয়ে বিচিত্র প্রতিভার অধিকারী সঙ্গীতব্যক্তিত্ব।
তা সত্ত্বেও হিন্দি রোমান্টিক গানে মান্না দে-কে খুব বেশি ব্যবহার করা হয়নি। এর কারণটা কী আমার সঠিক জানা নেই। হয়তো ওঁর গলার টিম্বারের জন্য। মান্না দে-র যে কণ্ঠবৈশিষ্ট্য, সেই বৈশিষ্ট্যের কারণে হয়তো রোমান্টিক হিরোর লিপে তাঁকে ব্যবহার করা হয়নি। গুরু দত্তের ছবিতে আমরা মান্না দে-কে শুনছি না, দেব আনন্দের ছবিতেও আমরা মান্না দে-র গান খুব কম শুনছি, বরং সে জায়গায় অনেক বেশি শুনছি মহম্মদ রফি বা তালাত মাহমুদের গান। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, গুরু দত্তের ‘পেয়াসা’ ছবিতে শচীন দেববর্মনের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে যে গান আমরা শুনছি, সেই গানে মান্নাবাবুকে যেন ঠিক কল্পনা করা যায় না। অন্যান্য গানে মান্নাবাবু ঝোড়ো হাওয়ার মতো গেয়েছেন লাইক অ্যান অ্যাক্ট অফ গড, কিন্তু কতগুলো ছবিতে যে রোমান্টিক ক্যারেক্টার, সেখানে মান্নাবাবুর অতটা জায়গা হয়নি। সেখানে বরং অনেক বেশি জায়গা করে নিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, মুকেশের মতো কণ্ঠশিল্পীরা। হিন্দি ছবিেত রোমান্টিক গানে সুবীর সেনও যে ডাক পেয়েছেন, মান্না দে কিন্তু তা পাননি। এটা খুব ইন্টারেস্টিং একটা বিষয়, কিন্তু এর হুবহু কারণটা আমার জানা নেই। বাংলা ছবির গানে কিন্তু এর উলটোটাই ঘটেছে। বাংলা ছবিতে প্রথমে মান্না দে অনাদৃত থেকেছেন দীর্ঘকাল, কিন্তু তারপর যখন সমাদর পেলেন তখন চুটিয়ে কাজ করেছেন এবং হিরোর লিেপই গেয়েছেন।
বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও মান্না দে ভারতের আরও বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন। মারাঠি, গুজরাটি, তেলেগু, মালয়ালম, তামিল, পাঞ্জাবি ভাষায় ওঁর গান আছে। মান্না দে-র উচ্চারণ অসম্ভব ভালো ছিল। ওঁকে যখন আমেরিকায় গান গাইতে নিয়ে যাওয়া হত, গুজরাটি বা মারাঠি কমিউনিটিই বেশিরভাগ নিয়ে যেত। ওখানে এরকম ঘটনা ঘটেছে যে, বাঙালি শ্রোতারা ওঁর কাছে বাংলা গান শুনতে চেয়েছেন আর উনি বলেছেন, ‘না, আমি বাংলা গান গাইব না। বাঙালিরা আমায় নিয়ে আসুন, তখন আমি বাংলা গান গাইব!’ আমার খুব ভালো লেগেছিল ওঁর এ কথা শুনে। এত গান ওঁর মারাঠি আর গুজরাটি ভাষায় ছিল, উনি সেগুলোই গাইতেন।
এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা মনে পড়ছে। 1973 সােল আমি প্রথমবার ফ্রান্সে যাই, তখন আমার 24 বছর বয়স। সেখানে কিছু আফগান, লেবানিজ়, ইরানি, অ্যালজেরিয়ান, আলবেনিয়ান ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। গানের ব্যাপারেই আলাপ হয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে আফগানরা কী পরিমাণ মান্না দে-র ভক্ত ছিলেন! মান্না দে-র অনেক গান ওঁরা গাইতেন। আমি তখন একটা পিয়ানো অ্যার্কডিয়ন বাজাতে চেষ্টা করতাম। বাঁ হাতের কাজগুলো করতে পারতাম না, ডান হাতে সলিল চৌধুরীর ভাষায় পারপেন্ডিকুলার হারমোিনয়ামের মতো করে বাজাতাম। সেই হারমোনিয়াম বাজিয়েছি নিউ ইয়ারের পার্টিতে আর সমস্বরে মান্না দে-র গাওয়া গানগুলো গেয়ে গেছেন আফগান ছেলেমেয়েরা, আলবেনিয়ান ছেলেমেয়েরা। আমার ধারণা ছিল না, ভারতের বাইরে ওই পরিমাণ তাঁর পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা।
মান্না দে-র মতো এরকম প্রতিভা নিয়ে, এরকম ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে, এরকম প্রশিক্ষণ নিয়ে, এতটা অভিজ্ঞতা, এতটা এক্সপোজ়ার নিয়ে আর কতজন শিল্পী সারা পৃথিবীতে গানের ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছেন, সন্দেহ। সে দিক থেকে দেখতে গেলে মান্না দে সঙ্গীতের একজন খুবই ইউনিক ব্যক্তিত্ব।"
Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়