আপডেট: ১২:২৭, ২০ জুলাই ২০১৯
জৈন্তাপুরের ’জৈন্তেশ্বরী বাড়ী’
সুমন্ত গুপ্ত: আকাশের মনের অবস্থা ভালো নেই। একটু পর পর অঝোর ধরায় কান্না করছে। এর মাঝেই আমাকে বের হতে হলো মনোয়ার ভাই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। বাসা থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে সোজা হাজির হই হোটেলের সামনে।
ফোন দিলাম মনোয়ার ভাই কে বললেন আমার অপেক্ষা করতে করতে সামনে গিয়েছেন হাঁটতে। আমি এই ফাঁকে যাত্রা পথে খাবার জন্য কিছু হালকা খাবার নিয়ে নিলাম। দশটার দিকে আমাদের কাঙ্ক্ষিত যাত্রা শুরু করলাম। আমার যাত্রা সঙ্গী মনোয়ার ভাই , ভাবী আর আমি।
মনোয়ার ভাই আমার অফিসের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত আছেন। অফিসের কাজে খুব ব্যেস্ত থাকেন তার মাঝে সময় পেলেই বের হয়ে পরেন ঘুরতে। মনোয়ার ভাই বললেন আসছি যেহেতু কোথাও ঘুরে আসি। আমি সব সময় ঘুরতে ভালোবাসি কোথাও যাবার কথা শুনলে না বলতে ভালো লাগেনা।
আমাদের আজকের গন্তব্য ’জৈন্তেশ্বরী বাড়ী’। সিলেট-তামাবিল সড়কের পাশে জৈন্তাপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ’জৈন্তেশ্বরী বাড়ী’র অবস্থান। এগিয়ে চলছি আমরা অঝোর বৃষ্টি ধারার মাঝে। আমি গাড়ির জানলার বাইরে হাত দিয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া পেতে চেষ্টা করলাম। বৃষ্টি বিধুর দিনে আমরা এগিয়ে চলছি। মহাসড়ক পেড়িয়ে আমরা এগিয়ে চলছি রাস্তার মাঝে মানুষের আনাগোনা ও কম। পথিমধ্যে দেশি চাঁপা কলার দেখা পেলেন মনোয়ার ভাই । সাথে সাথে চাঁপা কলার স্বাদ অনুভবের তাগিদ দেখে আমি গাড়ি থামাতে বললাম। নগর জীবনে ফরমালিন মুক্ত চাঁপা কলার স্বাদ পাওয়া বিরল ব্যাপার। তাই আমরা কেউই এই সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না। অসাধারণ স্বাদ ফরমালিন মুক্ত তাই একে একে তিন হালি কলা একাই আমি সাবাড় করলাম। পেট পূজা শেষ করে রওনা দিলাম গন্তব্যের পানে।

যাত্রা পথে আবার বৃষ্টি হানা দিলো সেই রকম বৃষ্টি। এর মাঝেই আমরা গন্তব্যে এসে পৌছালাম কিন্তু বাধ সাধল বৃষ্টি। মুষোল ধারে বৃষ্টির মাঝে গন্তব্যে পৌঁছেও বসে থাকতে হল চার চাকার বাহনে। আমাদের মত অনেকেই গাড়িতে বসে আছে বৃষ্টি কমার অপেক্ষায়। বৃষ্টি একটু ঝিম ধরার সাথে সাথে আমরা গাড়ি থেকে পড়লাম। হেঁটে চললাম বৃষ্টি কে সাথে নিয়ে। বৃষ্টির মাঝে চোখে পড়লো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড সংরক্ষিত পুরাকীর্তি । ভেতরে প্রবেশের পর দেখা পেলাম ভগ্ন প্রায় দেওয়ালের অংশ। ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলাম আমরা। সামনে একটি পুরনো ঘর দেখতে পেলাম। ঘরটির সামনে একটি সাইনবোর্ড দেখলাম ঘরটি ’ইরাদেবী মিলনায়তন’ । আমদের মত অনেকেই এসেছেন এই প্রাচীন পুরাকীর্তি দেখতে। দেখা পেলাম প্রবীণ সামাদ আহমেদের তিনি বললেন-'জৈন্তেশ্বরী বাড়ী’ মূলত: সিন্টেং বা জৈন্তা রাজাদের পূজিত দেবতার বাড়ী।
জৈন্তার রাজা যশোমানিক ১৬১৮ সালে অত্যন্ত আড়ম্বরে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত কালি দেবীর মূর্তিকে এ বাড়ীতে স্থাপন করেন এবং বাড়িটি নির্মাণ করেন। বাড়ীটির মধ্যখানে মূল মন্দির ঘরটির অবস্থান। বর্তমানেও মূল ঘরটির ভিটা এবং সংলগ্ন দক্ষিণের ঘরটি নানা দৈব-দুর্বিপাকের মধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা সংস্কার করে একদল হিতৈষী ব্যক্তি ঘরটি ’ইরাদেবী মিলনায়তন’ নামকরণ করেছেন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মাঝে মাঝে এতে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ঘরটির স্তম্ভ গুলো লোহার এবং স্থাপত্যশৈলী বেশ দৃষ্টিনন্দন। জৈন্তেশ্বরীর ইতিহাস জানতে চাইলে তিনি বলেন - রাজা ধন মানিক ১৫৯৬ থেকে ১৬০৬ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়ার অধিপতি ছিলেন । তাঁর মৃত্যুর পর ১৬০৬ সালে কাছাড় রাজ শত্রুদমন যশোমানিককে মুক্তি দেন। যশোমানিক দেশে ফিরে আসেন ও সিংহাসন লাভ করেন। ১৬১৮ সালে শত্রুদমন ও অসমরাজ প্রতাপ সিংহের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে প্রথমে কাছাড় রাজ পরাজিত হন। যুদ্ধ জয়ের পর অহম রাজ সেনাপতি সুন্দর গোসাইকে রহা দুর্গে রেখে নিজে রাজধানীতে প্রত্যর্পণ করেন। এ সুযোগে কাছাড় পতির ভ্রাতা ও সেনাপতি ভীমবল রহা দুর্গ আক্রমণ করেন। অতর্কিত এই আক্রমণ প্রতিরোধে তিনি অসমর্থ হন , অধিকাংশ সেনা মৃত্যুবরণ করে , বাকিরা পালিয়ে যায়। কাছাড়পতি এই বিজয়কে স্থায়ী করার জন্য রাজধানী মাইবঙ্গের নতুন নাম করেন ’কীর্তিপুর’। এ সময় থেকে কাছাড়পতিকে জৈন্তাপতি কর্তৃক বার্ষিক নজরানা দেওয়ার প্রথাও রহিত হয়। শত্রুদমনের এই বিজয়ের পর যশোমানিক কোচবিহার গমন করেন এবং কোচরাজ লক্ষ্মীনারায়ণের কন্যাকে বিয়ে করেন।
সে বিয়েতে যৌতুকস্বরূপ ধাতুনির্মিত মূল্যবান একটি দেবমূর্তি প্রাপ্ত হন। দেবী কালীর সে মূর্তিকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে জৈন্তাপুরে নিয়ে মহাসমারোহে ’জৈন্তেশ্বরী কালী’ নামে প্রতিষ্ঠিত করেন । যশোমানিকের পূর্বে রাজদরবারে জৈন্তা বা সিন্টেং রীতি-নীতি পালিত হতো কিন্তু এ মূর্তি স্থাপনের পরেই রাজকীয় পরিবারে হিন্দুদের মূর্তিপূজা শুরু হয়। সামাদ আহমেদের আমাদের পুরো এলাকা টি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। ঘরটির পশ্চিম দিকে দেয়াল সংলগ্ন প্রায় দু’ফুট উঁচু পাকা মঞ্চ ধাঁচের একটি জায়গা আছে, দেখে আমি বললাম এখানে কি হয় ? সামাদ সাহেব বললেন এটি ’চণ্ডীর থালা’ নামে পরিচিত। বিগত কয়েক দশক আগেও এখানে একজন ব্রাহ্মণ বসবাস করতেন। এ ঘরটি সংলগ্ন পেছনের দিকে আরেকটি ঘর ছিল, যেটির কয়েক ফুট উঁচু পাকার ভিটা এখনও দেখা যায়। এ ঘরটিই মূল মন্দির ঘর ছিল এবং এটি আয়তাকার। ভিত থাকলেও উপরের কাঠামোটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। সম্ভবত: এখানে জৈন্তেশ্বরী দেবী অধিষ্ঠিত ছিলেন । ঘরটি যে খুবই মজবুত ও সুরক্ষিত ছিল , তা বর্তমান ধ্বংসাবশেষ দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায়।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে দেবীর মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। এ ঘরটির দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পানির কুপ যা স্থানীয়দের কাছে ’ইন্দিরা’ নামে পরিচিত। কুপটি পাকার বাধানো এবং বর্তমানে এটির পানি আর ব্যবহার উপযোগী নয়। হঠাৎ আমি বললাম এখানে কোথায় নর বলি দেয়া হত বুঝি । ছোট বেলায় মার কাছে শুনতাম । উনি বললেন ঠিকই শুনেছেন, কথিত আছে ঐ পাকার উঁচু গোলাকৃতি একটি পাটাতন বা বেদী যেখানে মানুষ বলি দেওয়া হতো । এজন্য পাটাতনটি ’বলির পাটাতন’ নামে পরিচিত। বেদীটি বেলে পাথরের তৈরি এবং আয়তন প্রায় ৩ বর্গ মিটার। বেদীর গোলাকৃতি অংশ থেকে উত্তর দিকে ক্রমশ: নীচের দিকে একটি সিঁড়ি চলে গেছে । এটির দুটি ধাপ রয়েছে-প্রথমাংশ সামান্য উঁচু এবং পরের অংশ প্রথমাংশ থেকে খানিকটা নিচু হয়ে ক্রমশ: ভূমির দিকে চলে গেছে। সম্ভবত: নরবলি দেওয়ার নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এখানে সম্পাদিত হতো।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই মানুষ বলি দেওয়ার অপবাদেই (?) ব্রিটিশরা ১৮৩৫ সালে জৈন্তারাজ্য দখল করে নেয় । বর্তমানে বাড়ীটিতে মোট তিনটি ফটক দেখা যায়। প্রধান ফটকটি দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এবং সেটি সাবেক কালেব রাজকীয় ভাব অনেকটা ধরে রাখতে পেরেছে। যদিও সংস্কার ও পরিচর্যা অভাবে সেটি এখন প্রায় বিবর্ণ এবং ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের কারণে উপরের অংশটি ভেঙে পড়েছে। অপর গেইট দুটির একটি পূর্বদিকে এবং একটি পশ্চিমদিকে অবস্থিত । নিরাপত্তার জন্য সে দু’টি এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সম্ভবত: রাজা রাজবাড়ী হতে এ পূর্বদিকের গেইট দিয়েই যাতায়াত করতেন। তবে এ বাড়ীর সবচেয়ে আকর্ষণ এবং দর্শনীয় বিষয়টি হচ্ছে বাড়িটির বিরাট উঁচু দেয়াল। বিশাল এ বাড়িটির পুরোটাই ৮ হাত উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা এবং দেয়ালের মধ্যে হাতি, ঘোড়াসহ নানাপ্রকার প্রাণীর চিত্র অংকিত আছে। জৈন্তেশ্বরী বাড়ীর দেয়ালের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম দিকে আরেকটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ এখন দেখতে পাওয়া যায়। এটি সম্ভবত: রাজ্যের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মন্দিরের দক্ষিণ দিকটি রাজার দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে কথিত আছে এবং প্রধান ও অভিজাতদের বসার জন্য সেখানে পাথরের আসন রয়েছে।
সে পাথরগুলো ’মেগালিথিক’ নামে পরিচিত এবং এগুলো জৈন্তিয়ার প্রাচীনত্বের এক জীবন্ত নিদর্শন।
যাবেন কীভাবে -
ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে সিলেট। সিলেট থেকে এক ঘণ্টার পথ জৈন্তাপুর। বাস, মিনিবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মাইক্রোবাসে চড়ে জৈন্তাপুর চলে যেতে পারেন। উঠতে পারেন জৈন্তা হিল রিসোর্টে অথবা কাছের নলজুড়িতে জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয়। আগে থেকেই বুকিং দিয়ে যেতে হবে ডাকবাংলোয়। শহর থেকে মাইক্রবাস নিয়ে গেলে ভাড়া নিবে ২৫০০ থেকে ৩০০০।
লেখা ও ছবিঃ সুমন্ত গুপ্ত- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের