আপডেট: ১৭:৪৭, ৫ আগস্ট ২০১৯
প্রাণপ্রিয় ভাইয়াকে খুঁজছে মালিহা
‘মা বলে, ভাই মামা বাড়ি। মালিহা বলে, আমাকেও নিয়ে চলো। মা কখনো বলে, ভাইয়া কবরে। মালিহা বলে, ভাইয়ার কাছে কবরেই যাব!’
নিজস্ব প্রতিবেদক : মেয়ে জিজ্ঞেস করলো আব্বু ভাইয়া কোথায়? আমি বললাম তুমি কি ভাইয়ার কাছে যাবা? মেয়ে বললো হে সাত তলায়তো আছে। মেয়েতো জানেনা যে ভাইয়া কোথায় চলে গেছে, সেতো আর জীবনেও ফিরে আসবেনা। সে তো পরপারে চলে গেছে। আমি আমার মেয়েকে কী জবাব দিব? সে এখন তাঁর প্রাণপ্রিয় ভাইয়াকে খুঁজছে। ভাইয়াটা কোথায়? কথাগুলো বলছিলেন ডেঙ্গুতে ছেলে হারানো পিতা মমিনা সরকার।
এসিআই কর্মকর্তা মমিন সরকার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছয় বছর বয়সী মেয়ে মালিহা বিনতে সরকারকে নিয়ে আজ সোমবার (৫ আগস্ট) হাসপাতাল ছেড়েছেন, বুকের ধন ছেলেকে ছাড়াই। ডেঙ্গুতে দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়ে মালিহা। তবুও বারবার ভাইয়াকে খুঁজছে সে। জবাব দেবার ভাষা নাই বাবা মমিন সরকারের। শুধু একবার মেয়ের দিকে তাকান, আরেকবার স্ত্রী ও স্ত্রী জান্নাত আরা জাহানের দিকে। মা জান্নাত আরা জাহান ঢুকরে কেঁদেও কাঁদতে পারছেন না। ছোট্ট মালিহা প্রাণপ্রিয় ভাইয়ার মৃত্যুশোক সইবে কেমন করে।
মা বলে, ভাই মামা বাড়ি। মালিহা বলে, আমাকেও নিয়ে চলো। মা কখনো বলে, ভাইয়া কবরে। মালিহা বলে, ভাইয়ার কাছে কবরেই যাব!’
গত শুক্রবার দুপুরে ১১ বছর ৭ মাস বয়সী ছেলে মো. রাইয়ান সরকার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তখন মেয়ে মালিহা হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।
মমিন সরকার বলেন, মেয়ে এখনো বুঝতে পারছে না তার ভাইয়া মারা গেছে। বারবার ভাইয়ের কাছে যেতে চাইছে। মেয়ের কথা চিন্তা করে নিজের বাসায় না গিয়ে মিরপুরে তার মামার বাসায় যাচ্ছি। পরে তাকে বুঝিয়ে বলবো ভাইয়ের মৃত্যুর কথা। তবে মালিহা খুব দুর্বল হয়ে গেছে, ভাইয়ের খবর শুনে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটাই চিন্তার।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শোক করার সুযোগ পাননি রাইয়ানের বাবা মমিন সরকার ও মা জান্নাত আরা জাহান। কারণ, ছয় মেয়ে মালিহাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো।
ছোট্ট রাইয়ানকে নিয়ে যত স্মৃতিমোমিন সরকার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, আহা! আমার রাইয়ান! কত স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়ে, কত স্মৃতি! ১১ বছর ৭ মাস ধরে ছেলেটাকে কত যত্ন আর মমতায় বড় করলাম। গেল মাসে সাঁতারে ভর্তি করিয়েছিলাম। শুক্রবার করে দু’টো ক্লাসও করেছে সাঁতারের। ছেলেটাকে আমার চেয়েও বড় কিছু বানাব ভেবেছিলাম। ওর মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করেও কোনো চাকরি করেনি শুধু সন্তান মানুষ করার জন্য। নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ছেলেকে মানুষ করার সুযোগ আর পেল কই!
চোখের কোণে জমানো পানি লুকানোর চেষ্টা করে রাইয়ানের বাবা বলেন, আমার ছেলেটা খুব মেধাবী ছিল। খুব খেলাধূলা পছন্দ করত। স্কুলে মোজা পরে খেলত, জুতা নোংরা করত না। পাছে মা টের পায়। বাসায় ফিরে নিজেই মোজা ধুয়ে ফেলত। আমি অফিস থেকে ফিরলেই বলত, বাবা, ল্যাপটপটা দিবা? আমরা গ্রহ-তারা-নক্ষত্র দেখব, সমুদ্রের তলদেশ দেখব। এসবে রাইয়ানের খুব আগ্রহ ছিল। খুব শান্ত ছিল ছেলেটা আমার, ভাত খেতে পছন্দ করত। খুব সাহসীও ছিল আমার ছেলে।
ছেলের কথা যেন ফুরতেই চায় না। ছেলে কোন কোন স্কুলে পড়েছে, কোথায় কবে কোন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে— সব খুঁটে খুঁটে স্মৃতি থেকে বের করে আনলেন মোমিন সরকার।
মোমিন বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে আজ তিন দিন। এখনো আমার মেয়েটি জানেই না তার ভাই আর নেই। সে জানে, ভাই এই হাসপাতালেই ভর্তি। মৃত্যু সম্পর্কেও তার তেমন ধারণা নেই। তাই একটু পরপরই জেদ করে, চলো, ভাইয়ের কাছে যাব। ওর মা বলে, ভাই মামা বাড়ি। মালিহা বলে, আমাকেও নিয়ে চলো। মা কখনো বলে, ভাইয়া কবরে। মালিহা বলে, ভাইয়ার কাছে কবরেই যাব!’
একটু থেমে মোমিন বলেন, ‘গতকাল একবার হাসপাতাল থেকে স্ত্রীকে নিয়ে শেখেরটেকে বাড়িতে যাই। আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে ওরা ভাইবোন হুড়োহুড়ি করত, কে আগে দরজা খুলে দেবে। কতদিন ব্যাথাও পেয়েছে। কিন্তু কাল কেউ এলো না, দরজা খুলল না কেউ! ওদের মা— ছেলের পোশাক, বই-খাতা, স্কুল ব্যাগ— সব ধরে ধরে কাঁদছিল। আমাকে বলল, চলো, রাইয়ানের স্কুলের গেটে গিয়ে একটু দাঁড়িয়ে থাকি!’
‘স্ত্রীকে কী বলে সান্তনা দেবো বলেন? নিজেকেই তো সামলাতে পারছি না। আমি বেসরকারি চাকরি করি। ওদের সময় খুব কম দিতে পারি। মা-ই ওদের বেশি সময় দিত। আমি তো অফিসের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ব। ওদের মা কী করবে? রাইয়ানের অস্তিত্ব আমাদের পুরোটা জুড়ে। ওর সময় কী করে কাটবে। আমাদের দু’জনের জীবনের বিনিময়েও যদি ছেলেটাকে বাঁচানো যেত! হাসপাতালে আসা সহকর্মীরা কত টাকা নিয়ে এসেছেন এই হাসপাতালে— আমার এমডি, জিএম সবাই। বলেছিলেন, বিদেশে নিতে হলেও তারাই খরচ দেবেন। ওদের সবার কাছে দোয়া চেয়েছি । কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জনের কাছে ছেলের জন্য, ছেলেকে বাঁচাতে দোয়া চাইলাম ! কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম না,’— বলতে বলতে যেন গলা বুঁজে আসে মোমিন সরকারের।
খানিকটা সময় আর কথা সরে না না। একটু চুপ থাকেন। আবার বলতে শুরু করেন, ‘সঠিক সময়ে হাসপাতালে সিট পেলে, সময়মতো চিকিৎসা পেলে ছেলেটাকে হয়তো হারাতে হতো না!’ আবেগ, বেদনা থেকে এবার বাবার কণ্ঠে ক্ষোভ।
কান্নায় ভেঙে পড়েন অসহায় বাবা মমিন সরকার। আফসোসের যেন শেষ নেই। টেস্ট রিপোর্টটা দ্রুত পেলে হয়তো ছেলেকে বঁচানো যেতো। মমনি সরকার বলেন, ‘একদিনে রক্ত দিতে হয়, আর পরের দিন পাওয়া যায় রিপোর্ট। সময়টা যদি কমানো যেতো। যদি ১৫ মিনিট, আধা ঘন্টা বা ২ ঘন্টার ভেতরও রিপোর্টটা আসতো। তাহলে আমি সাথে সাথে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। কিন্তু সে সুযোগটাও আমাকে, আমার বাচ্চাটাকে দেওয়া হয়নাই।’
মমিন সরকার বলেন, ‘বাড়িটা ছেড়ে অন্য কোথাও যাব ভাবছি।’ রাজধানীর শেখেরটেকের বাড়িটার ওপরই যেন যত ক্ষোভ মোমিনের। ওই বাসাতেই যে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় রাইয়ান ও মালিহা।
তবে কোনোভাবেই ওই বাসা ছাড়তে রাজি নন রাইয়ানের মা জান্নাত আরা। ‘আমাদের ছেলের সব স্মৃতি তো ওই বাসাতেই। কিভাবে ছেড়ে যাব এই বাড়ি!,’ স্ত্রীর কথাই উদ্ধৃত করছিলেন মোমিন।
ওর স্কুলের ব্যাগ ঘরে ওভাবেই পড়ে আছে। টেবিলে বই-খাতা সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। ছেলের ড্রয়িং খাতা, বল— সবকিছু ও যেভাবে রেখেছিল, ঠিক সেভাবেই আছে,।’
রাইয়ান সরকার রাজধানীর সরকারি মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। মমিন সরকার ফেসবুকে ছেলেমেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও হাসপাতালে ভর্তি—এ তথ্য জানিয়ে সবার কাছে দোয়া চেয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।
গত বছর ছেলে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে, ভালো ফল করে জীবনের প্রথম ধাপ যাতে ভালোভাবে অর্জন করতে পারে, এ কারণে সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। আর এখন তো ছেলে জীবনের সব ধাপই পার করে ফেলল।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংগ্রামের কথামমিন সরকার বললেন, ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে। তাহলে হাসপাতালগুলোয় কেন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হবে না? আইসিডিডিআরবিতে ডায়রিয়া বা কলেরা রোগী গেলে ক্যাম্পাসের ভেতরের রাস্তায় বিছানা ফেলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় অন্যান্য হাসপাতাল তা করতে পারবে না কেন? হাসপাতালগুলো তাদের হাসপাতালে কতগুলো সিট খালি আছে, তা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে প্রচার করতে পারে। তাহলে তো আর রোগী নিয়ে দৌড়াতে হয় না। ডেঙ্গুতে মানুষ দিশেহারা। কোন পরিস্থিতিতে কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে, তা জানতেই পারছে না। সরকার কি প্রচার বাড়াতে পারে না?
মমিন সরকার জানালেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংগ্রামের কথা। গত ২৮ জুলাই রাতে জ্বর শুরু হয়েছিল রাইয়ানের। তবে সকাল থেকেই বলছিল, শরীরটা ভালো লাগছে না। জ্বর জ্বর লাগছে। নাপা খাইয়ে ছেলেকে স্কুলে পাঠানো হয়। বলা হয়, শরীর খারাপ লাগলেই শিক্ষকদের বলে যেন ফোন দেয়। ছেলে স্কুলে গিয়ে পেছনে বসে ঘুমিয়ে যায়। স্কুল ছুটির পর নিজেই হাতমুখ ধুয়ে রিকশা নিয়ে শেখেরটেকে বাসায় চলে আসে। বাসায় এসেও বলে শরীর দুর্বল লাগছে। রাতে জ্বর বাড়তে থাকে। সাপোজিটরি দিলে জ্বর কমে, আবার বাড়ে।
২৯ জুলাই সন্ধ্যায় রাইয়ানকে এক শিশু বিশেষজ্ঞের চেম্বারে নিলে জ্বর ১০৫.১৪ ডিগ্রি, অর্থাৎ প্রায় ১০৬ ডিগ্রি হয়ে যায়। চিকিৎসক অন্যান্য রোগী দেখা বাদ দিয়ে চেম্বারেই সাপোজিটরি দেন। ডেঙ্গু টেস্ট করাতে বলেন। মিরপুরে একটি হাসপাতালে টেস্ট করাতে গেলে চারটা টেস্টের দাম চায় ৩ হাজার ৪৮০ টাকা। এর চেয়েও বড় কথা, তারা জরুরি ভিত্তিতে রিপোর্ট দিতে পারবে না। পরে ছেলেকে নিয়ে কল্যাণপুরে আরেকটি হাসপাতালে যাই। সেখানে টেস্টের দাম রাখে ১ হাজার ৮৪০ টাকা। তারাও পরের দিন ছাড়া রিপোর্ট দিতে পারবে না বলে জানায়।
৩০ জুলাই ডেঙ্গু পজিটিভ বলে রিপোর্ট পাওয়া যায়। তবে এর মধ্যেই ছেলের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। তবে তখন জ্বর আর নেই। তখন ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তির যুদ্ধ শুরু হয়। শংকরে ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসককে দেখানোসহ নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করতে করতে বেলা দুইটা বেজে যায়। আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে অন্যান্য হাসপাতালে খবর নিতে থাকেন। তবে সব জায়গা থেকেই খবর পাওয়া যায় সিট খালি নেই। তারপর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় ছেলেকে। যানজটসহ নানা জটিলতায় এ হাসপাতালে পৌঁছাতে অনেকটুকু সময় নষ্ট হয়। তবে হাসপাতালে যাওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকেরা। দুই ঘণ্টা পরপর নতুন রিপোর্ট দিতে থাকেন। চলতে থাকে যমে মানুষে টানাটানি।
গত ৩১ জুলাই দিবাগত রাত তিনটার দিকে রাইয়ানকে এনআইসিইউতে ভর্তি করা হলো। ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়ার তিন দিন আগে মেয়েরও ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। মেয়েরও বমি ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে। হাসপাতালে ছেলেকে এনআইসিইউতে ভর্তির পর ছেলের কেবিনেই মেয়েকে ভর্তি করানো হলো।
১ আগস্ট অপেক্ষার পালা শুরু। ছেলেকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হলো। আর ২ আগস্ট শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর চিকিৎসক ডেকে পাঠালেন। বললেন, অনুমতি পাওয়া গেলে ছেলের ভেন্টিলেশন খুলে ফেলা হবে। এই বাবা-মা যা বোঝার বুঝে গেলেন।
মমিন সরকার বললেন, ছেলে মারা যাওয়ার আগে একবার চিকিৎসক আশা দিয়েছিলেন। কিন্তু বাঁচানো গেল না।
এসটি/ইএন
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের