Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০১ মে ২০২৫,   বৈশাখ ১৮ ১৪৩২

শ্যামলাল গোসাঁই

প্রকাশিত: ১৮:৩৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
আপডেট: ১৯:৪৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

একজন উপাচার্যের তালেবানি মনোবাসনা কতোখানি যুক্তিযুক্ত?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শব্দটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সর্বাধিক ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে একটি বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এই সরকার বেশকিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগও নিয়েছেন। রাজাকারদের ফাঁসি কার্যকর বা বিচারের আওতায় আনা এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু স্বাধীনতার পঞ্চাশটি বছর পেরিয়েও আমরা যেন এক অদৃশ্য চেতনাবিরোধী টানে আটকে আছি। আটকে আছেন আমাদের শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত তরুণ, তরুণী, নেতা-নেত্রী ব্যাংকার, প্রশাসক, অধ্যাপক, উপাচার্যরাও। যেকারণে, মুক্তির এতোদিন পরেও এ দেশে আমাদেরকে শুনতে হয় 'তালেবানি কালচার' কায়েম করে শিক্ষার্থীদের বন্দী করার মনোবাসনার কথা। শুধু তাই নয়, আমাদের একজন উপাচার্য শিক্ষার্থীদের উপর তাঁর চালানো তালেবানি 'তালেবানি কালচারে'র ব্যাপারে গর্ব করার বিষয়ও বড় গলায় স্বীকার করেছেন! 



আপাতঃ দৃষ্টিতে ঘটনাটির শুরু সিলেটের শাবিপ্রবির উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের একটি বক্তব্যকে ঘিরে মনে হলেও এই মনোবাসনার জন্ম বা সূত্রপাত আরো বহুবছর আগে থেকে। তবে আগে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন কী বলেছিলেন সেটি আরেকবার পড়া যাক। গত ২০ সেপ্টেম্বর সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি অডিটরিয়ামে আয়োজিত ‘তথ্য অধিকার’ বিষয়ক এক সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে উপাচার্য বলেন, ‘সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, এখানে (বিশ্ববিদ্যালয়) ওপেন কালচার ছিল, ছেলেমেয়েরা যা খুশি, তাই করতে পারত। কেউ কিছু বলতে পারত না। কারণ, তাঁদের বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আমি বলেছি, সাড়ে ১০টার মধ্যে হলে ঢুকতে হবে। তারা (শিক্ষার্থী) এটার নাম দিয়েছে তালেবানি কালচার। তালেবানি কালচার নিয়ে আমি খুবই গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওপেন কালচার চাই না।’

আমাদের দেশে এখন যতো হারে শিক্ষার বিকাশ ঘটছে তারচেয়ে বেশি হারে বিকাশ ঘটছে সাম্প্রদায়িকতার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িকতার সেই বিকাশ ঠেকাতে পারছে না। বরং, এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন বা শিক্ষক রূপে শিক্ষা দিচ্ছেন তাঁরাও জ্ঞানে, অজ্ঞানে সেই পশ্চাদপদতার গানই শোনান। দেশ যেন ভরে যাচ্ছে পরসংস্কৃতিতে। শাড়ি-ব্লাউজ কিংবা সালোয়ার-কামিজে এখন আর আমাদের মেয়েদের তেমন দেখা যায় না। বোরকা-হিজাবে দেশের পথঘাট ছেয়ে যাচ্ছে। যা ঘোর সাম্প্রদায়িকতার নিরব প্রদর্শনীর মতো।

উপাচার্যের এহেন বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের পর থেকেই সারাদেশে একপ্রকার আলোচনার ঝড় বইছে। অবশ্য বইবারই কথা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণকে যেখানে শিক্ষার্থীদের মানসগঠনের মুক্তাঙ্গন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন সাহেব সেখানে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'তালেবানি কালচার' চালু করে শিক্ষার্থীদের বদ্ধ করতে চান। তিনি শিক্ষার্থীদেরকে একটা সময়সীমায় বেঁধে রাখতে চান। সে তিনি রাখতেই পারেন। কিন্তু বাধ সেধেছে ওই 'তালেবানি কালচার' শব্দটিতে। একজন উপাচার্যের মুখে এহেন শব্দ কতোটুকু শোভা পায়?

২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় তালেবান। শুরুতে তালেবানের প্রতিশ্রুতি ছিল পূর্বের তুলনায় উদার হবে তারা। নারীদের স্বাধীনতার প্রশ্নে শরিয়া আইন অনুযায়ী পর্দা রক্ষা করে পড়াশোনা ও চাকরির অধিকার থাকবে বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ২ বছর পর দেখা যাচ্ছে, কথা রাখেনি তালেবান। আফগানিস্তানের সব পার্লার ও বিউটি সেলুন বন্ধ করেছে তালেবান। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অন্তত ৬০ হাজার নারী। এদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সংকুচিত হয়েছে নারীদের শিক্ষার অধিকার। এ বছর নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনীত মানবাধিকারকর্মী মাহবুবা সিরাজ মনে করেন, আফগানিস্তানে নারী স্বাধীনতা বলতে আর কিছুই নেই। তার মতে, 'সমাজ থেকেই ধীরে ধীরে মুছে দেওয়া হচ্ছে নারীদের। তাদের মতপ্রকাশ, তাদের কথা, চিন্তা সবকিছুই মুছে দেওয়া হচ্ছে।' এই হলো তালেবানি কালচারের একাংশের চিত্র। 

উপাচার্যের ওই বক্তব্যের পর অনেকের মতো আমার মনেও প্রশ্ন জাগছে- তাহলে কী শাবিপ্রবির উপাচার্য তালেবানি শাসনকে মনে মনে সমর্থন করেন? গোটা দুনিয়াসুদ্ধ লোকেদের কাছে যখন তালেবান শাসন আফগানিস্তানের ইতিহাসে সময়ের এক নিষ্ঠুর অধ্যায় হিসেবে মনে করছেন তখন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন কোন প্রেক্ষিতে তালেবাসি কালচার নিয়ে গৌরবান্বিত বোধ করছেন? অনেকে অবশ্য এ কথাও বলছেন, উপাচার্য সজ্ঞানে এ কথা হয়তো বলেন নি। হয়তো সত্যিই সজ্ঞানে বলেন নি, কিন্তু যে উপাচার্যকে নিয়ে এখানে আলাপ হচ্ছে তিনি যে এবারই প্রথম এমন মনোবাসনা ব্যক্ত করেছেন তা ঠিক নয়। মনে করিয়ে দেয়া দরকার, এর আগে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন সাহেব জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন। সেসময় তিনি বলেছিলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের সহজে কেউ বউ হিসেবে নিতে চায় না।’ তাঁর এই দুই বক্তব্যেরই প্রেক্ষাগৃহ যে এক সেটা বুঝতে সমাজবিজ্ঞানী হবার প্রয়োজন নেই। উপাচার্যের দুইটি বক্তবই তালেবান কালচার ঘেঁষা। তাই পরপর দুইটি বক্তব্যকে অসতর্কভাবে বলেছেন ভাবাটা মুশকিলের হবে। বরং, জোর দিয়ে এটা খোঁজা দরকার ফরিদ উদ্দিন সাহেবের (উপাচার্য) এসব কথার নেপথ্যে তাঁর আদর্শের জায়গাটি। 

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে নতুন করে হিজাব বা বোরকার বিষয়টি যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে হঠাৎ কেউ এ দেশে ঘুরতে এলে পাকিস্তানেরই কোনো অঙ্গরাজ্য বা আফগান ভূমি ভেবে ভুল করতে পারেন। বহুকাল ধরে আসা আমাদের সংস্কৃতিকে চাপা দিয়ে যেসব ভুঁইফোড় তালেবানি সংস্কৃতি এ দেশে ক্রমশ বিকাশ লাভ করছে তা আসন্ন ভবিষ্যতে আমাদের জন্য আতঙ্কের হয়ে দাঁড়াবে। আর এমন পরিস্থিতিতে যখন একটি শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের একজন শিক্ষক বলেন, ‘তালেবানি কালচার নিয়ে আমি খুবই গৌরবান্বিত, এটা নিয়ে থাকতে চাই। আমি ওপেন কালচার চাই না’ তখন গাঁয়ের আনপড় তালেবানি কালচারের সমর্থক একজন হেফাজত কর্মীর সঙ্গে এই উপাচার্যের তফাৎ তেমন চোখে পড়ে না। 

২.
গ্রামের বাড়িতে আমার এক খালাতো ভাই আছে। তবলীগপন্থী একজন কট্টর ধার্মিক। তিনি আবার তালেবানের একজন শক্তপোক্ত সমর্থকও। তালেবান যখন সর্বশেষ ২০২১ সালে আফগানিস্তানের দখল নিলো এবং মার্কিন সেনাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো, আমার সেই খালাতো ভাইয়ের খুশি আর ধরে না। যেন বাংলাদেশ মার্কিনিদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। এর কিছুদিন পর যখন তালেবাস সরকার নারীদের শিক্ষা, এনজিও এবং বাইরে যাবার ব্যাপারে কট্টর হতে শুরু করলো আমার খালাতো ভাই তখন বলছিলেন, এবারে আফগানিস্তানে সুখ, শান্তি ফিরে আসবে। এতোদিন আল্লাহর গজব ছিল আফগানিস্তানে। তালেবানদের প্রত্যাবর্তনে সে গজব দূর হয়েছে। নারীরা এখন পূর্ণরূপে গৃহে থেকে স্বামীর হক্ব পূরণ করবে। 

এবার যখন শাবিপ্রবির উপাচার্য মহাশয়ের বক্তব্য পড়লাম, তখন আমার সেই খালাতো ভাইয়ের কথা মনে পড়ল। এই দুজনের মধ্যে যেন আমি অমিল কম মিলই খুঁজে পেলাম বেশি। একজন মনে মনে তালেবানি কালচার ধারণ করেন আরেকজন ঢাকঢোল পিটিয়ে এই তাঁদের পার্থক্য। 

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে পঞ্চাশ বছর পেরিয়েছে। সে হিসেবে রাষ্ট্র বা জাতী হিসেবে আমরা আর শিশু নেই। কিন্তু, এখনো যখন কেউ কেউ আমাদেরকে তাঁদের পশ্চাদপদ মনোবাসনার কথা শোনান তখন অবাক হবার চাইতে আতঙ্কিত হতে হয় বেশি। আমরা যে কালচার থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব একটা কালচার গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছি এতোদিন ধরে, আমরা যে কালো অন্ধকার সময় পেরিয়ে ঔজ্জ্বল্যের দিকে হাঁটছি সেই পিছপথেই যেন তাঁরা নিয়ে যেতে চায় দেশটাকে। 

আমাদের দেশে এখন যতো হারে শিক্ষার বিকাশ ঘটছে তারচেয়ে বেশি হারে বিকাশ ঘটছে সাম্প্রদায়িকতার। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সাম্প্রদায়িকতার সেই বিকাশ ঠেকাতে পারছে না। বরং, এই শিক্ষা ব্যবস্থায় যারা উচ্চশিক্ষিত হচ্ছেন বা শিক্ষক রূপে শিক্ষা দিচ্ছেন তাঁরাও জ্ঞানে, অজ্ঞানে সেই পশ্চাদপদতার গানই শোনান। দেশ যেন ভরে যাচ্ছে পরসংস্কৃতিতে। শাড়ি-ব্লাউজ কিংবা সালোয়ার-কামিজে এখন আর আমাদের মেয়েদের তেমন দেখা যায় না। বোরকা-হিজাবে দেশের পথঘাট ছেয়ে যাচ্ছে। যা ঘোর সাম্প্রদায়িকতার নিরব প্রদর্শনীর মতো। আমরা সবাই দেখছি কীভাবে আমাদের সংস্কৃতি বদলে পরসংস্কৃতি জায়গা করে নিচ্ছে, আমরা শুনছি কিভাবে একজন শিক্ষাবিদ তালেবানি কালচার নিয়ে গর্ব করছেন কিন্তু আমরা কিচ্ছু করতে পারছি না। যাদের করার কথা তাঁরা যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। ভাবটা এমন যেন, দেশটা আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো হয়ে গেলেই যেন এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ খুশি হবেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শব্দটি নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার যে গুরুত্ব প্রদর্শন করে এসব ক্ষেত্রে তার যেন কোনো প্রতিফলন নেই। তালেবানি কালচারে শাসন কায়েম করে খুশি হওয়া উপাচার্যের মনোবাসনা কতোখানি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সেটা ক্ষমতাসীন সরকারের বিবেচনায় আনার সময় কী এখনো হয় নি? 


লেখক: শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী 

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়