Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বুধবার   ১২ নভেম্বর ২০২৫,   কার্তিক ২৮ ১৪৩২

শ্যামলাল গোঁসাই

প্রকাশিত: ১৪:৪৬, ২৩ নভেম্বর ২০২০
আপডেট: ১৫:১৫, ২৩ নভেম্বর ২০২০

বাদল রায়: যিনি ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবলের পেলে

প্রতিকৃতি: আইনিউজ

প্রতিকৃতি: আইনিউজ

ফুটবল সম্রাট পেলেকে মনে আছে? ব্রাজিলের হয়ে হলুদ জার্সি গায়ে মাঠে নামা এক কালো যুবক। গোলরক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে যিনি অজস্র গোল করে চোখ ধাঁধিয়েছেন দর্শকদের। তাঁর মতো ফুটবল খেলোয়াড় হয়তো আর কেউ আসবে না। সম্ভবত একারণেই তাকে ফুটবলের সম্রাট উপাধি দেওয়া হয়েছে।

একদিন কোনো মঞ্চে যদি হঠাৎ ফুটবল সম্রাটের নামের সাথে বাদল রায় নামটি উচ্চারণ করে, বাংলাদেশ কি একবার শ্রবণেই চিনে নিতে পারবে এই বাদল রায়কে? হয়তো চেনা যাবে না, অনেকে বলতে পারেন ফুটবল সম্রাট পেলের সঙ্গে বাদল রায় নামটি বড়ই বেমানান। কিন্তু এটাও সত্যি যে পেলে যদি ফুটবল বিশ্বের কাছে ফুটবল সম্রাট, তাহলে বাদল রায়ও বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এক ফুটবল সম্রাটেরই নাম। এক সময় দেশের ফুটবলের এক অবিচ্ছেদ্য নাম বাদল রায় বর্তমান প্রজন্মের কাছে একটি অজানা অধ্যায় হলেও আশির দশকে যারা ফুটবলের খোঁজ রাখতেন তাদের কাছে নামটি একেবারেই নতুন নয়।

মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে সিএন্ডবি’র হয়ে যাত্রা শুরু। এরপরের বছর সুযোগ মেলে ইয়ংম্যান স্পোর্টিংয়ের হয়ে

আশির দশকের কথা, কুমিল্লার এলাকাভিত্তিক ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোতে একটি নাম পরিচিত হচ্ছিলো ধীরে ধীরে। নামের মানুষটি ১৭ বছর বয়সী হালকাপাতলা শরীরে এক কিশোর, বাদল রায়। আঞ্চলিক টুর্নামেন্টগুলো দারুণ পারফরম্যান্সের কারণে জনপ্রিয় হতে থাকেন বাদল। সুযোগ আসে কাব ফুটবলে পা রাখার। সেই সুযোগে ১৯৭৪ সালে কুমিল্লা দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল লিগে সিএন্ডবি’র হয়ে খেলে ক্লাব ফুটবলের যাত্রা শুরু। সেই সুবাদে পরের বছরই সুযোগ মেলে ইয়ংম্যান স্পোর্টিংয়ের হয়ে। এতদিন দ্বিতীয় বিভাগে খেলা বাদল রায় ইয়ংম্যান সোসাইটির সহযোগিতায় এবার নাম লেখালেন প্রথম বিভাগের ফুটবলে। ফুটবল ম্যাচটির প্রতিপক্ষ ছিলো বাংলাদেশ ফুটবলের জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান। বাদল রায় নেমেছেন এই দলের বিপক্ষে খেলতে। নিজ দলের হয়ে ওই ম্যাচে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। লিকলিকে শরীরের এই যুবকের খেলা চোখে পড়ে প্রতিপক্ষ মোহামেডান কতৃপক্ষের। যার বদৌলতে পরের বছরেই কুমিল্লা ছেড়ে বাদল রায়ের ঠিকানা হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফুটবল ক্লাব মোহামেডানে।

বাদল রায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর জালে বল জড়াতে বেশ পটু ছিলেন। এক যুগেরও বেশি ক্যারিয়ারে আবাহনীর বিপক্ষে ভিন্ন পাঁচ ম্যাচে করেছেন পাঁচ গোল। আর বাদলের গোল মানে দলের জয়। আবাহনীর বিপক্ষে ওই পাঁচ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টিতে হেরেছে মোহামেডান।

মোহামেডানে যোগ দেওয়ার পর থেকে মোহামেডান আর বাদল রায় ছিলেন একটি নাম।  এই সাদা কালো জার্সিধারী মোহামেডানের হয়ে অধিনায়কত্ব করেছেন লম্বা সময়। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মোহামেডানকে নেতৃত্ব দিয়ে লিগ শিরোপা। এছাড়া খেলোয়াড় হিসেবে মোহামেডানের জার্সিতে জিতেছেন ছয়টি শিরোপা। ক্যারিয়ারের শুরুতে স্ট্রাইকার হিসেবে খেললেও পরবর্তীতে হয়ে যান অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। কিন্তু গোল করার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনেন নি বাদল। মাঠে পজিশন বদলালেও আগের মতোই গোল করার অভ্যাস ধরে রেখেছিলেন।

১৯৭৭ সালে আগা খান গোল্ডকাপে ফুটবলে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মোহামেডানের জার্সিতে নামেন ১ম ম্যাচ খেলতে। থামেন ১৯৮৯ সালে।

বাদল রায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর জালে বল জড়াতে বেশ পটু ছিলেন। এক যুগেরও বেশি ক্যারিয়ারে আবাহনীর বিপক্ষে ভিন্ন পাঁচ ম্যাচে করেছেন পাঁচ গোল। আর বাদলের গোল মানে দলের জয়। আবাহনীর বিপক্ষে ওই পাঁচ ম্যাচের মধ্যে মাত্র ১টিতে হেরেছে মোহামেডান।

বাদলের গোল মানে দলের জয়, জাতীয় দলের ক্ষেত্রেও কথাটি ছিল দারুণ সত্য। জাতীয় দলেও অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে খেলা বাদল করিয়েছেন অনেক গোল। কিন্তু যখনই গোল করেছেন, জয় দেখেছে জাতীয় দল।

১৯৮২ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমসে তার গোলেই মালয়েশিয়াকে হারিয়ে ১ম জয় পায় বাংলাদেশ। ১৯৮৬ সালে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ সাদা দলের। প্রেসিডেন্টস গোল্ড কাপ নামে এই টুর্নামেন্টে তার নেতৃত্বে এই ‘প্রায় মোহামেডান’ দলটিকে সেমিফাইনালে তোলেন অধিনায়ক বাদল।

নিজের অসাধারণ পারফর্ম্যান্সের কারণে বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে বাদল রায় নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। হয়েছেন বাঙালির ফুটবল ইতিহাসের এক কিংবদন্তী। খেলোয়াড়ি জীবনে মাঠে যেমন নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন তেমনি মাঠ ছাড়ার পর ফুটবলের একজন সংগঠক হিসেবেও প্রমাণ করেছেন।

২০১৭ সালে ব্রেন স্ট্রোক করেন দেশের ফুটবলের এই কিংবদন্তী। এ যেন মৃত্যুযাত্রায় প্রথম পা ফেলা। ধীরে ধীরে ফুটবল মাঠের সাথে বাড়তে থাকে দূরত্ব। ২০২০ সালের শুরুতে আবারও স্ট্রোক হয়। শরীরে ধরা পড়ে চতুর্থ স্তরের লিভার। বাদল রায় হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন মন সায় দিলেও শরীর আর সায় দিবে না। তাই বাফুফের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। তারপর দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে বাসা-হাসপাতাল দৌড়াদৌড়িও কম করেন নি। এলো করোনা, অসুস্থ বাদল রায় আরও অসুস্থ হতে থাকলেন। এক পর্যায়ে পৃথিবী থেকেই বিদায় নিলেন বাংলাদেশের ফুটবলের এই মানুষটি।

২০১৭ সালে ব্রেন স্ট্রোক দিয়ে শুরু। এরপর চলতি বছরের শুরুতে আবারও করেন স্ট্রোক। এরপর করোনার আক্রমণ। তারপর চতুর্থ স্তরের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। শরীরের সঙ্গে না পেরে প্রাণের সংগঠন বাফুফের নির্বাচনে থাকতে পারেননি, থাকতে পারেননি পৃথিবীর বুকেও।

রোববার (২২ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডিটে বাংলাদেশ মেডিকেলে চিকিৎসারত অবস্থায় বাদল রায় যখন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বাফুফেতেও নেমে আসে শোকের ছায়া। বর্তমান প্রজন্ম না জানলেও বাফুফে জানে বাদল রায়ের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ফুটবল কতো দামি একটি রত্নকে হারালো। 

আইনিউজ/এইচএ

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়