সাহিত্য প্রতিবেদক
আপডেট: ১৯:৩৮, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দি আউটসাইডার: মুনতাসীর মামুনের লেখায় কাম্যুর দর্শন পাঠ
আলবেয়ার কাম্যুর বই `দি আউটসাইডার` দর্শন।
১.
কিছুদিন আগে, মৌলভীবাজারে বসা ভ্রাম্যমাণ বইমেলা থেকে আলবেয়ার কাম্যুর 'দি আউটসাইডার' উপন্যাসের একটা অনুবাদ্গ্রন্থ কিনে এনেছিলাম। ছোট্ট একটা বই (৯৪ পৃষ্ঠা)। আমি পড়েছি মুনতাসীর মামুনের অনুবাদ। লেখক ভূমিকাতেই লিখেছেন- গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করলেও এতে ইউরোপের আবহটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বই পড়েও তাই মনে হলো।
লেখক গোটা অনুবাদটা করেছেন ইউরোপের আবহ যথাসম্ভব ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিছু জায়গায় অবশ্য অপচেষ্টা মনে হয়েছে। কিন্তু, মূল আলোচ্য বিষয় মুনতাসীর মামুনের অনুবাদের প্রসঙ্গ নয়। অনুবাদকৃত 'দি আউটসাইডার' উপন্যাসটি।
মসিয়ে মারসো। 'দি আউটসাইডার' গল্পের নায়ক। যাকে ফ্রান্সের হাজারও মানুষের সামনে প্রকাশ্যে শি র চ্ছে দ করা হবে। তাঁর এই মৃ ত্যু যেন এক বর্ণাঢ্য উৎসব। কিন্তু, মসিয়ের তাঁর এই মৃ ত্যু নিয়ে ভয় নেই, অনুতাপ নেই। উপরন্তু, গর্ব হচ্ছে হয়তো। নাহলেও অস্বাভাবিক নয়। সে এ নিয়ে ভাবতে চায় না। কিন্তু, তাঁর গর্ব হলো তাঁর নিজের কাছে স্পষ্টতার প্রতি, নিজের যুক্তির প্রতি। বরং রাগ, হলো নিজের পক্ষের উকিলের প্রতি। যিনি একটি সহজ, সরল ঘটনাকে বারবার প্যাচিয়ে মসিয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন বারবার! কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পেরেছেন কি মসিয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করতে? আসামি মসিয়ে তো নিজেও জানতো রায় তাঁর বিরুদ্ধেই যাবে। তাঁর শি র চ্ছে দে র শাস্তিকে মসিয়ে সাদরেই যেন গ্রহণ করছিলো!
আসলে, বইটা শেষ হবার পর মনে হলো শেষ হলো কেন? এ উপন্যাস পড়ে একটা পুরোনো বিষয় কিন্তু, নতুনভাবে পড়েছি। এটি অনেক সময় গুরুজন বা শিক্ষকেরা আমাদেরকে উপদেশ আকারে বলতেন: 'নিজের অবস্থান এবং বক্তব্য বা যুক্তি নিয়ে নিজের মধ্যে কোনো সংশয় না থাকা।' অর্থাৎ, আমি যা করছি তাঁর ঠিকঠাক যুক্তি নিয়ে নিজের কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে। যা এই বইটির মূল চরিত্র মসিয়ে মারসো-র একটি বড় বৈশিষ্ট্য। মসিয়ে ব্যক্তিজীবনে খুবই যৌক্তিক। নিজের প্রতিটি কাজ, তর্ক, পদক্ষেপের ব্যাপারে সজাগ এবং আবেগের বশীভূত না থেকে সে প্রতিটি বিষয় নিয়ে অগ্রসর হয়।
এর ফলে, সে অতীত নিয়ে ভেবে বিচলিত হতে চায় না। আগত ভবিষ্যৎ নিয়েও তাঁর নেই কোনো আশঙ্কা। সে শুধু বর্তমানকে তাঁর পূর্ণ যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারে এবং সেভাবেই দিন যাপন করে, উপভোগ করতে চায়। সে নারীসঙ্গ উপভোগ করে। কিন্তু, বিয়ের মতো বিষয়ে বিশ্বাসহীন। যদিও এরমাঝে তাঁর জীবন নারী, যৌ ন তা এবং পরিশেষে খু নে র মতো কুটিল বিষয়গুলোর সাথে জড়িয়ে পড়ে। যার পরিণাম স্বরূপ সবশেষে তাঁকে আদালতে শি র চ্ছে দ এর রায় শুনতে। মৃ ত্যু দ ণ্ডে র রায়ের পর থেকে মসিয়ে আবিষ্কার করে তাঁর আশেপাশের সবাই, তাঁর প্রিয়তমা মারি, বন্ধু রেমন্ড, সেলেস্তে সবার চোখেই আসলে সে একজন অপরাধী! এবং সবাই তাঁকে ভুলে যাচ্ছে।
এই ভুলে যাওয়াটাকে মসিয়ে আবেগ দিয়ে নয়। যুক্তি দিয়ে বুঝতে চাইলো। তাঁর রাগ হলো না। সে জানে যখন তাঁর শি র চ্ছে দে র রায় ঘোষণা করা হয়, সে একটিবারের মতোও ভয়ে কেঁপে ওঠেনি! তাঁর চোখ দিয়ে পানির স্রোত নেমে আসেনি, যা মৃ ত্যু দ ণ্ডে র রায় পাওয়া অন্য আসামীরা করে। বরং, সে বিচারকের এ রায়ের বিপক্ষে নীরবতাই পালন করেছে। সে জানে, তাঁর হাতে একজনের খু ন হয়েছে। এবং ঘটেছে কিছু আকস্মিক, রহস্যজনক ঘটনা। যা তাঁকে খু নে র ব্যাপারে খারাপভাবে ফাসিয়ে দিয়েছে। তবু, সে সরল মনে এটা স্বীকার করেছে যে, তাঁর হাতে একজনের প্রাণ গেছে। এই অপরাধে তাঁর শি র চ্ছে দ এর রায় দেওয়া হয়েছে। ক'দিন পরেই তাঁর শিরচ্ছেদ কর হবে। এরমধ্যে একদিন ফাদার আসলেন। তওবা করানোর জন্য। বললেন: 'জীবনের শেষ সময়ে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হও। তিনিই তোমাকে রক্ষা করবেন।' যেখানে যুক্তির বিচারে আসন্ন মৃ ত্যু কে সে স্পষ্ট দেখছে সেখানে ফাদারের এমন ধর্মের আহ্বানে বরং মসিয়ে বিরক্ত হলো। সে বললো: আমি জানি, অপরাধীরাই নিজেদের মৃ ত্যু র আগে ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়। আমি অপরাধী নই যে, তাঁর শরণাপন্ন হবো। আমি আমার মৃ ত্যু র রায়ের ব্যাপারে নিজের কাছে সংশয়হীন। আমি জানি কেন এ রায় হয়েছে। মসিয়ে এই পরিস্থিতিতে বিচলিত হলো না। বরং, খুশি হচ্ছে এই ভেবে যে, তাঁর জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত সে নিজের কাছে স্পষ্ট ছিল। তাঁর প্রতিটি কাজে স্পষ্টতা ছিল। তাই শি র চ্ছে দ এর এই বিষয় তাঁকে অস্বাভাবিক কোনও ভয় ধরাতে পারলো না। সে জানে এটা হওয়াই আমার জীবনের সাধারণ কিন্তু যৌক্তিক পরিণতি। আমার হাতেই ওই আরব যুবকটি খু ন হয়েছে।
২.
মসিয়ে আরেকটি বিষয়ও আবিষ্কার করলো, এই কয়েকটি অসংলগ্ন ঘটনার কারণে তাঁর সাদামাটা জীবন নিয়েও হইরই ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। তাঁর মৃ ত্যু যেন এক মহা আয়োজন। বিগত কয়েকদিন ধরে পত্রিকায় ফলাও করে ওরে খবর ছাপছে। এমনকি মসিয়ে লক্ষ্য করেছে, আদালতে যখন তাঁকে তোলা হয় মামলার শুনানির জন্য। তখনো পুরো আদালত কক্ষটি মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সবাই তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করে। কেউ খুব খারাপভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এরমাঝে একজনকে সে আলাদা করে দেখেছে। যে, শি র চ্ছে দে র রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত মসিয়ের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
মসিয়ে মারসো। 'দি আউটসাইডার' গল্পের নায়ক। যাকে ফ্রান্সের হাজারও মানুষের সামনে প্রকাশ্যে শি র চ্ছে দ করা হবে। তাঁর এই মৃ ত্যু যেন এক বর্ণাঢ্য উৎসব। মসিয়ের তাঁর এই মৃ ত্যু নিয়ে ভয় নেই, অনুতাপ নেই। উপরন্তু, গর্ব হচ্ছে হয়তো। নাহলেও অস্বাভাবিক নয়। সে এ নিয়ে ভাবতে চায় না। কিন্তু, তাঁর গর্ব হলো তাঁর নিজের কাছে স্পষ্টতার প্রতি, নিজের যুক্তির প্রতি। বরং রাগ, হলো নিজের পক্ষের উকিলের প্রতি। যিনি একটি সহজ, সরল ঘটনাকে বারবার প্যাচিয়ে মসিয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলেন বারবার! কিন্তু, শেষ পর্যন্ত পেরেছেন কি মসিয়েকে নির্দোষ প্রমাণ করতে? আসামি মসিয়ে তো নিজেও জানতো রায় তাঁর বিরুদ্ধেই যাবে। তাঁর শি র চ্ছে দে র শাস্তিকে মসিয়ে সাদরেই যেন গ্রহণ করছিলো! তবু, নিজেকে নিজের কাছে স্পষ্ট রেখেছিল। জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়েও।
৩.
আলবেয়ার কাম্যুর এই উপন্যাসটি এক কথায় দারুণ। যারা পড়েন নি, আমি বলবো বেশি দামে সস্তা মানের প্রেমের উপন্যাস না পড়ে এটি পড়ুন উপকৃত হবেন। আমাদের দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে পাঠকের সংখ্যা হয়তো অনেক। কিন্তু, 'মানসম্পন্ন' পাঠক স্বল্পই আছেন। সাধারণ পাঠকের মধ্যে শ্রেণীবিভেদ করায় অনেকে ক্ষেপে যেতে পারেন। তথাপি, এটা তো সত্য যে আরিফ আজাদের বইয়ের পাঠক আর হুমায়ুন আজাদের বইঠের পাঠকের মধ্যে যে সম্পর্কটা আকাশ-পাতাল তফাতের, সম্পর্কটা দা-কুমড়োর।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা