শাহ শরীফ উদ্দিন, সিলেট
আপডেট: ০২:০২, ২৩ মার্চ ২০২১
সিলেটে হোটেল কোয়ারেন্টিনে লন্ডন প্রবাসীর বিয়ে
কোয়ারেন্টাইন হোটেলে বিয়ে
এবার সিলেটে হোটেল কোয়ারেন্টিনে লন্ডন প্রবাসীর বিয়ে -এর তথ্য মিলেছে। হোটেল ব্রিটানিয়া থেকে ৯ প্রবাসী উধাও হওয়ার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে কোয়ারেন্টাইনে থাকা অবস্থায় সিলেটের লামাবাজারে অবস্থিত 'হোটেল লাভিস্তা'র অভ্যন্তরে লন্ডন ফেরত এক প্রবাসীর বিয়ে করার তথ্য পাওয়া গেছে। এমনকি কোয়ারেন্টাইনে থেকেই অনেকটা আয়োজন করে বাইরে থেকে কনে এনে বিয়ের অনুষ্ঠান সেরেছেন বলে জানা গেছে। গত ২০ মার্চ রাতে ঘটা করে এ আয়োজন করা হয়েছিল।
জানা যায়, গত ১৮ মার্চ সিলেটে আসা যাত্রীদের মধ্যে ১১ জনকে হোটেল লাভিস্তায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়। এদের মধ্যে লন্ডন ফেরত দুইজন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জাঙ্গাইল এলাকার বাসিন্দা এক নারী (৪৮) ও তার ছেলে (২৮)। মা ছিলেন হোটেলের ৪০১ নম্বর কক্ষে আর তার ছেলে ৪০৬ নম্বর কক্ষে।
নিয়ম অনুযায়ী তারা সব ধরণের জনসমাগম এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলার কথা থাকলেও লাভিস্তা হোটেলে স্টেজ সাজিয়ে অনুষ্ঠান করে বিয়ে করলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ওই যুবক (২৮)। আর এ বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন বাইরে থেকে আসা প্রায় ৫০ জন মানুষ। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভূরিভোজও হয় হোটেলের রেস্টুরেন্টে। বিয়ের এ আনুষ্ঠানিকতা রাত ৮ টার পর শুরু হলেও একই হোটেলেই এনগেজমেন্ট অনুষ্ঠান হয় ১৮ মার্চ বিকেলে।
সূত্র জানায়, ছেলের বিয়ে উপলক্ষে বাইরে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন বিপনিবিতান থেকে কেনাকাটাও করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকা যুক্তরাজ্য প্রবাসী যুবকের মা। যার পুরোটাই হয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষের যোগ সাজেশে। যার বিনিময় হোটেল কর্তৃপক্ষ আদায় করেছেন মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা।
ধামাচাপা দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ
এমন তথ্যের ভিত্তিতে সরেজমিনে সোমবার (২২ মার্চ) বিকাল ৪ টার দিকে হোটেল লাভিস্তায় গেলে কর্তৃপক্ষ শুরু করেন টালবাহানা। প্রথমে পুরো ঘটনা অস্বীকার করে ধামাচাপা দেওয়া শুরু করলেও পরে বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। প্রথমে হোটেল অভ্যর্থনার দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ পুরো ঘটনা অস্বীকার করে বলেন, 'এমন কোন ঘটনাই হয়নি। এমনকি এসব কক্ষে কোন প্রবাসীয় অবস্থান করছেন না।' একই সাথে গত ১৫ এবং আজ ২২ মার্চের দুইটি তালিকা দেখিয়ে আর কোনো প্রবাসী অবস্থান করছেন না মর্মে জানান।
পরে অন্য একটি সূত্র থেকে ১৮ তারিখে হোটেল লাভিস্তায় আসা ১১ জনের তালিকা সংগ্রহ করে নাম এবং কক্ষ নম্বর মিলে যাচাই করা হলে দেখা ৪০১ এবং ৪০৬ নম্বর কক্ষে অবস্থান করছেন মা-ছেলে। আর তাতেই শুরু হয় ব্যবস্থাপক তারেক আহমদের কালক্ষেপণ। মূহুর্তে লাপাত্তা হয়ে যান তিনি। পরে প্রায় ঘন্টাখানেক পর আবার ফিরেন তিনি। এসময় তিনি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার কথা অস্বীকার করলেও 'আকদ (বিবাহ রেজিস্ট্রি) হয়েছে মর্মে জানান'। যার পুরো দৃশ্যই ওই হোটেলের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত রয়েছে। বিয়ের পর কনে ৪০৬ নম্বর কক্ষেই বরের সাথে অবস্থান করছেন এমন তথ্য জানিয়ে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখতে চাইলে অপরগতা প্রকাশ করেন ব্যবস্থাপক।
লাভিস্তা হোটেলের ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ বলেন, 'বিয়ের অনুষ্ঠান এটা ভুল। তবে আকদ হয়েছে (বিবাহ রেজিস্ট্রি)। এজন্য কাজিসহ ৪ থেকে ৫ জন মানুষ এসে তারা কেবল স্বাক্ষর নিয়েছেন। মূলত মানবিক দিক বিবেচনায় সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদেরকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে।'
কত তারিখ এবং কখন হয়েছে তা জানতে চাইলে ব্যবস্থাপক প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বর রেখে পরবর্তী আধা ঘণ্টার মধ্যে জানাবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সন্ধ্যা ৭ টার ভেতর একাধিকবার ব্যবস্থাপকের মোবাইল নম্বরে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে অভিযুক্ত যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ছেলে ও তাঁর মায়ের সাথে কথা বলতে চাইলে তাৎক্ষণিক সুযোগ না দিয়ে ফোনে কথা বলিয়ে দিবেন বলেও জানান হোটেল লাভিস্তার ব্যবস্থাপক তারেক আহমদ।
অনিয়মের তথ্য আছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে
প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের এমন আজব খবর কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ না। অভিযোগ আছে নগরীর অধিকাংশ হোটেলের বিরুদ্ধে। এসব হোটেলে অবস্থানরত প্রবাসীরা হোটেল কর্তৃপক্ষকে 'ম্যানেজ' করে বের হন বাইরে। ঘুরেন, প্রয়োজনে স্বজনদের সাথে দেখা করেন। ইচ্ছা হলে কেনাকাটাও করেন। যার পুরোটাই হয় হোটেল কর্তৃপক্ষের সাহায্যে।
এমন আজগুবি কাণ্ডের একাধিক অভিযোগ গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। সূত্র জানায় সম্প্রতি এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২১ মার্চ প্রথমে আম্বরখানার ব্রিটানিয়া হোটেলে পরিদর্শনে যান এনএসআইয়ের দুই কর্মকর্তা। দুপুর ২ টা ৩০ মিনিটের দিকে তারা হোটেলে গেলে হোটেলের ২০৩, ৬০৩ নম্বর কক্ষের দরজা বন্ধ দেখতে পান। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ জানান ওই দুই কক্ষের লোকজন ঘুমে আছেন। পরবর্তীতে এনএসআইয়ের পক্ষ থেকে তাদের ডাকার জন্য বলা হলে কথা পরিবর্তন করেন কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকেই শুরু হয় তোড়জোড়। এসময় ফোন দেওয়া হলে এসব কক্ষে অবস্থানকারী প্রবাসীরা জানান জকিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন এবং সন্ধ্যায় ফিরবেন। এমন অবস্থায় সিলেটে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা নিয়ে চলছে সমালোচনা।
একই সাথে প্রশ্ন উঠছে সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিভাবে বেরিয়ে গেলেন এসব প্রবাসী। দায় এড়াতে পারেন না পুলিশ প্রশাসনও। কেবল তাই না, হোটেল ব্রিটানিয়ার প্রবেশ পথের পাশের এক মুদি দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'নামেই কোয়ারেন্টাইন। টাকা হলে সব কিছু করা যায়। যারা কোয়ারেন্টাইনে থাকেন তারা সব সময়ই আমার দোকান থেকে এসে বিভিন্ন জিনিস কিনে নেন।'
আর হোটেলেরই একটি সূত্র জানিয়েছে প্রায়ই এরকম প্রবাসীরা বাইরে যান। এর বিনিময় যারা দায়িত্বে থাকেন তাদের আলাদা টাকা দিয়ে খুশি করতে হয়।
এ ব্যাপারে ব্রিটানিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপক কাওসার খান বলেন, 'সকালে একবার এবং রাতে একবার আমরা রুটিন চেক করি। ওইদিন সকালেও এসব প্রবাসীরা রেস্টুরেন্ট থেকে সকালের নাস্তা গ্রহণ করেছেন তাই আমরা ধরেই নিয়েছি তারা আছেন। কিন্তু দুপুরে হঠাৎ করে মনে হলো তারা হোটেলে নেই। তখন তাদের খোঁজ করা শুরু করলে এমন সময় এনএসআইয়ের এক সদস্য এসে উপস্থিত হন। তবে আমরাই প্রথমে তাদের অনুপস্থিতি বুঝে খোঁজ করা শুরু করি।'
সকলের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা গেলেন কি করে এমন প্রশ্নে ব্যবস্থাপক কাওসার খান বলেন, 'সকাল তখন সাড়ে ৭ টা। হয়তো রিসিপশনে যিনি ছিলেন তিনি কোন কারণে একটু সরেছেন। আর তখন পুলিশ ছিলো না। আর গার্ড অন্য কাজে ছিলো। এ সুযোগেই তারা চলে গেছে।'
অনিয়ম আছে অন্য হোটেলগুলোতেও
নড়বড়ে আর কোয়ারেন্টাইন নামক বেহাল এ দশার হিসেব এখানেই শেষ না। করোনার নতুন ধরণ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা থাকার কারণে বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা করা হলেও সিভিল সার্জনের অনুমতিতে মিলে বাইরে বের হওয়ায় সুযোগ। লিখিত আবেদনের মাধ্যমে এ সুযোগ নিয়ে কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রবাসীরা ঘুরেন অনায়াসে। সেক্ষেত্রে করোনা ছড়ানোর শঙ্কা থাকে কি না তা নিয়েও আছে প্রশ্ন।
জানা গেছে, ২১ মার্চ সোমবার ব্রিটানিয়া হোটেল পরিদর্শন শেষে বিকাল সাড়ে ৩ টার দিকে দরগাগেট 'হোটেল হলি গেট' পরিদর্শনে যান এনএসআইয়ের ওই দুই কর্মকর্তা, সেখানে গিয়ে লিমু মিয়া (৬০), মনু মিয়া (৫২), রওশন আরা সাথী (৪৯), সজেদা বেগমকে (৪১) অনুপস্থিত পান। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের চারজনের বাইরে বের হওয়ায় জন্য সিভিল সার্জনের অনুমতিপত্র দেখান। তবে সে অনুমতির সময়েও আছে প্রশ্ন। ওই ছাড়পত্রে বাইরে অবস্থান করার জন্য এ চারজনকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত অনুমতি প্রদান করা হলেও বিকাল সাড়ে ৩ টায়ও তারা উপস্থিত ছিলেন না হোটেলে।
আছে প্রবাসীদের অভিযোগ
এমনকি প্রবাসীদের পক্ষ থেকেও আছে হোটেলগুলোর বিরুদ্ধে নানান হয়রানির অভিযোগ। দুর্গতি-দুর্ভোগ, আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রশাসনিক বিভিন্ন অবজ্ঞা ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে গত শনিবার ২০ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করেছেন এক প্রবাসী। এ সংবাদ সম্মেলনে লাকি মিয়া নামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী ‘অমানবিক যন্ত্রণা, বন্দিদশা ও ক্ষতির’ হাত থেকে মুক্তির জন্য হোটেল কোয়ারেন্টাইন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
কঠোর হচ্ছে প্রশাসন
তবে এসবের বিরুদ্ধে এবার কিছুটা পদক্ষেপও নিচ্ছে প্রশাসন। হোটেল ব্রিটানিয়া থেকে ৯ প্রবাসী উধাও হওয়ায় ঘটনার পর পর শিশু ছাড়া ৬ জনকে ৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন সিলেট জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেজবাহ উদ্দিন আহমদ। আর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্রিটানিয়া হোটেলের সাথে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
তবে সকল কিছুর জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ হলেও দোষ পুলিশ প্রশাসনের উপর চাপানো হয় বলে মন্তব্য করলেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) বিএম আশরাফ উল্যাহ তাহের।
তিনি বলেন, 'পুলিশের কাজ হচ্ছে নিরাপত্তা দেওয়া। হোটেল কর্তৃপক্ষ কোন সমস্যা অনুভব করলে পুলিশকে জানাবেন। কিন্তু তারা পুলিশের অগোচরে অন্যান্য বোর্ডারের মতো প্রবাসীদের বিয়ে করার, বাইরে বের হওয়ার সুযোগ দিয়ে দোষ চাপায় পুলিশের উপর।
অপরদিকে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক, অতিরিক্ত দায়িত্ব) আ.ন.ম. বদরুদ্দোজা বলেন, আমরা এসব বিষয়ে কঠোর হচ্ছি। কিন্তু সকল কিছুর উর্ধ্বে সচেতনতা। চাইলেই কারো সাথে আসামির মত আচরণ সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে প্রবাসীদের সহযোগিতা করতে হবে। আর হোটেল কর্তৃপক্ষের ব্যাপারে ইতোমধ্যে দেখেছেন আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। তাছাড়া লাভিস্তার বিয়ের বিষয়টি আমি এখন অবগত হলাম। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’
- করোনা জয় করে সুস্থ হয়েছেন মৌলভীবাজারের ৩ চিকিৎসক