শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১৮:১৯, ২ মার্চ ২০২৪
নীল শার্ট | বেইলি রোডের আগুন নিয়ে গল্প
১.
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন। এবছরটা লিপ ইয়ার বলে ফেব্রুয়ারি মাস উনত্রিশ দিনের। এরকম দিন চার বছর পরপর আসে। তাই সকলেই চায় একটু বিশেষভাবে দিনটিকে স্মরণীয় করতে। এমন দিনে যাদের জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী তাদের তো আর কথাই নেই। আনিছও তার ব্যতিক্রম নয়। ওর জন্ম দিনটা ঊনত্রিশ ফেব্রুয়ারি। চার বছর পরপর নিজের জন্মদিন পালনের সুযোগ পায় আনিছ। দুনিয়ায় যে কয়টি লোক উনত্রিশ ফেব্রুয়ারিতে জন্মানো আর বিয়ে করার গৌরব অর্জন করেছেন আনিছ তাদের একজন। অবশ্য, এটা গৌরব না দুর্ভাগ্য মাঝেমাঝে ভাবে সে। যেমন: খাওয়া খরচার দিক হিসেব করলে একদিক থেকে ভালোই। ফি বছর পার্টি দিতে হয়না বন্ধুদের। আবার খারাপ দিকটা হলো চার বছর পরপর এমন দিন আসে বলে ওর বন্ধুদের অনেকেই ওর জন্মদিনের কথা ভুলে যায়। উইশ আসে কম। এ ব্যাপারটা খারাপ লাগে আনিছের। তাই চার বছর পরপর যখন ঊনত্রিশ ফেব্রুয়ারি আসে জন্মদিনটা ঘটা করে পালন করে। যেন আগামী চারবছর তা মনে থাকে।
অফিস শেষ হতে হতে রোজই রাত আটটা বেজে যায়। আজ আনিছ বসকে নিজের জন্মদিনের মিষ্টি খাইয়ে গুল মেরে একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়েছে। প্রথমে বাসায় গিয়ে ভালো করে একটা শাওয়ার নিলো। তারপর চার বছর আগে শেষবার পালিত জন্মদিনে মিলি যে শার্টটা দিয়েছিল সেটা গায়ে পরলো। হাতে ফুটপাত থেকে অল্প দামে কেনা ঘড়ি আর গতরে কিছুদিন আগে ইতালি ফেরত এক মামার দেয়া পারফিউম লাগিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল আনিছ। চুলটা মাঝ বরাবর নয়, এক পাশ থেকে ফিতা কেটে আঁচড়িয়ে আয়নায় নিজের থুবড়া দেখে কী যেন ভাবল। নীল রঙের এ শার্টটা ওকে মানায় দারুণ। মিলির পছন্দ কড়া বলতে হবে। কিন্তু, মেয়েটি শেষ পর্যন্ত আনিছকে ছেড়ে চলে গেল। অবশ্য, এ নিয়ে আনিছ নিজের ভাগ্যকেই দোষে, মিলিকে নয়। কেউ যদি বিলেত ফেরত স্বামী পায়, আইইএলটিএস ছাড়াই তার সঙ্গে বিলেত যাওয়ার সুযোগ পায়, আনিছের মতো সকাল-সন্ধ্যা ডিউটি মারা ছাপোষা লোকের সঙ্গে থাকবে কেন? মিলিও তো শেষ দিকটায় প্রায় প্রতিদিনই বলতো— 'শুধু মুখের কথা আর মনের আবেগ দিয়ে প্রেমের নৌকা দৌড়লেও জীবন দৌড়ে না।' মিলি সেটা বুঝতে পেরেছে বলেই হয়তো চলে গেছে। তবে, যাওয়ার আগে এ শার্টটা উপহার দিয়ে গেছে। যা এখন ওর স্মৃতি মাত্র। মিলি ভেবে শরীরে জড়ানো যায়। আজকে জন্মদিনের এই সন্ধ্যায় নীল এই শার্টটা আনিছকে মিলির ভাবনায় মাত করে রাখল কিছুক্ষণ। যদিও ভাবনার ঘোরে পড়ে বেশি দেরি করল না আনিছ। জাফর, সালাহউদ্দীন, স্বপন আর মীরাদের বলেছে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আসতে। ওখানেই আজকে ওর জন্মদিনের পার্টিটা হবে। চার বছর পরপর পালন করে বলে পার্টিতে আনিছ খরচাও করে উদার হস্তে। আজকে সবাইকে কাচ্চি ভাইয়ের স্পেশাল কাচ্চি খাওয়াবে। ওরাই জন্মদিনে পার্টিটা চেয়েছে। আনিছ নারাজি হয়নি। বরং, কিছুটা উচ্ছ্বসিত। যাক, চলতি জীবনে পরিচয় হওয়া এ মানুষগুলো অন্তত চার বছর পরপর আসা আনিছের জন্মদিনটা মনে রেখেছে।
আনিছের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। জন্মদিনটাই কি শেষপর্যন্ত ওর মৃত্যুদিন হতে চলেছে? না না! আনিছ বাঁচতে চায়। ওর এখনো বিয়ে হয়নি। বিয়েটা মায়ের জন্য করেনি। মায়ের চোখের অপারেশন করাতে হবে আগে। এজন্যই তো এতো খেটেখুটে মরছে ঢাকা শহরে। মায়ের চোখটা অপারেশন করিয়ে সামনের ফাল্গুনেই হয়তো বউ ঘরে আনবে। কিন্তু, এ কী দেখছে চোখের সামনে আনিছ! সকল দোয়ার বন্ধ করে কেউ যেন ওকে যমের সামনে ছেড়ে দিয়েছে! আনিছের আরেকবার রুস্তমের কথা মনে পড়ে। রুস্তমেরও মায়ের চোখে অপারেশনের কথা বলেছিল! সাবধানে থাকতে বলেছিল! কেন বলেছিল? কে এই রুস্তম! আনিছ কিছু ভাবতে পারে না।
আনিছ বাসার দরজায় তালা দিয়ে সোজা নিচে নেমে আসে। অনেকটা তাড়াহুড়ো করে। আটটা বেজে গেছে। সবাইকে এই সময় কাচ্চি ভাইয়ে থাকার কথা বলেছে অথচ, নিজে এখনো বাসার সামনে! উবার থেকে একটা ট্যাক্সি চেয়ে নিয়েছিল আগেই। বাসার গেটে পৌঁছে দেখে ট্যাক্সি চলে এসেছে। সাধারণত ট্যাক্সি ডেকে এনে এমন বাবুয়ানি আনিছ করে না। আজ করছে দুইটা কারণে। প্রথমত, আজকে ওর জন্মদিন। দ্বিতীয়ত, এরিমধ্যে ও অনেকখানি দেরি করে ফেলেছে।
ট্যাক্সিতে ওঠে বসলো আনিছ। গাড়িচালক তরুণ বয়সী। সামনে গ্লাসের কাছে রাখা বিসিএস প্রিমিলারি পরীক্ষার প্রস্তুতি বই। ঢাকা শহরে এমনটা এখন হরহামেশা দেখা যায়। কেউ হয়তো উবার বা পাঠাওয়ে চাকরি করছে সাথে বিসিএসের বই নিয়ে ঘুরছে। অবসরে যখন কোনো ট্রিপ থাকে না তখন পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চালক তরুণ আর বয়স দোষে বেশ চটপটে। গাড়ি একটু দূর না যেতেই বললো: 'পারফিউমটা নিশ্চয়ই ইতালি থেকে আনানো স্যার?'
আনিছ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। পরে যখন বুঝতে পারল ছেলেটা পারফিউমের কথা বলছে, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো: 'হ্যাঁ, আমার মেঝো মামা গেল সপ্তাহে ইতালি থেকে ফিরেছেন। উনিই এটা গিফট হিসেবে দিয়েছেন। তুমি বুঝলে কীভাবে এটা ইতালিয়ান প্রোডাক্ট?'
চটপটে ছেলেটা গাড়ি চালাতে চালাতে মৃদু হেসে জবাব দিল— 'কিছু প্রোডাক্ট দুনিয়ার সব জায়গায় মিলে না স্যার। এক জায়গাতেই পাওয়া যায়। এ পারফিউমের গন্ধ আমার পরিচিত। একটা সময় নিজেও পারফিউম বানাতাম। বাসাতেই ছোট্ট কারখানা ছিল। দেশবিদেশের নামি-দামি পারফিউম সংগ্রহে ছিল। পারফিউম সংগ্রহ করা একটা বাতিক হয়ে গিয়েছিল। আমি পারফিউমের গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারি এটা ভাল নাকি ভেজাল। আপনি যে পারফিউমটা আজ লাগিয়েছেন এর নাম 'সালভাতেরো ফ্যারাগামো'। ঠিক বলেছি স্যার?'
আনিছ অবাক হল বটে। সরল একটা হাসি হেসে নিয়ে বললো: 'বাহ! তুমি তো অনেককিছুই জানো তাহলে। আমি এটার নাম জানি না। হয়তো সালভাতেরো ফ্যারাগামোই হবে। নাম কী তোমার?'
'রুস্তম।' বললো গাড়িচালক তরুণ।
আনিছ বললো: 'তা রুস্তম। তুমি কি বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছো? বই দেখছি সাথে।'
রুস্তম বললো: 'জ্বী স্যার। আসলে নিশ্চিত কোনো চাকরিবাকরি হচ্ছে না। অথচ, মাস্টার্স কমপ্লিট করে বসে আছি। আমার আম্মার একটা চোখে সমস্যা। অপারেশনের জন্য বেশকিছু টাকা লাগবে। এই টাকার কারণে নিজের ব্যবসাও সাজাতে পারলাম না। এখন রেন্টে এই কারটা নিয়েছি। আর বিসিএসটাই এখন শেষ লক্ষ্য। এটা হয়ে গেলে হয়তো আম্মার চোখের একটা বিহিত করতে পারব।'
'ভালো ভালো।' এটুকু বলেই থেমে যায় আনিছ। বেইলি রোডে ওরা চলে এসেছে। রেস্টুরেন্টের সামনে অনেকগুলো সিলিন্ডার সারিবদ্ধ করে রাখায় পার্কিং এর জায়গা নেই। রুস্তম এগিয়ে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে। কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টটা ছয়তলা ভবনের চার তলায়। রুস্তমকে ভাড়া মিটিয়ে দেয়ার সময় দুইশো টাকা বেশি দিল আনিছ। কিন্তু, রুস্তম নিল না। বললো, 'সাধারণত কেউ অতিরিক্ত ভাড়া দিলে আমি না করি না স্যার। কিন্তু, আজ আজকে আপনার কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতে মন সায় দিচ্ছে না। আমাকে ভাড়ার টাকাটাই দিন। আর আপনে সাবধানে থাকবেন।'
আনিছ আরেকবার কিছুটা অবাক হলো। ঢাকা শহরে কোনও চালককে অতিরিক্ত টাকা দিলে খুশিই হয়। ফিরিয়ে দেওয়া তো দূর কি বাত। তাছাড়া, ওকে সাবধানে থাকার কথা কেন বললো? আর কথা না বাড়িয়ে রুস্তমকে ওর ভাড়ার টাকাটা দিয়ে বিদায় নেয় আনিছ রুস্তমও হাসিমুখে বিদায় নিলো নতুন যাত্রীকে পিক্ করার জন্য। ওদিকে আনিছও ততোক্ষণে সিড়ি আর ওর কালো জুতার শক্ত সোলে খটখট আওয়াজ তোলতে তোলতে চারতলায় কাচ্চি ভাইয়ের দিকে উঠে গেল।
২.
কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের প্রবেশ পথে আজকে অনেক মানুষের জটলা। ভেতরেও এক অবস্থা। অবশ্য, হওয়ারই কথা। লিপ ইয়ারের শেষ দিন আজ। সপ্তাহেরও শেষ দিন। তাছাড়া, আনিছের মতো আরও অনেকে এখানে প্রিয়জনদের নিয়ে এসেছেন খানাপিনার জন্য। কারো চার বছর পর জন্মদিন পালিত হচ্ছে আবার কারো চার বছর পর ম্যারেজ এনিভার্সারি। লোকাধিক্য থাকার আরেকটা কারণও আছে। ঊনত্রিশ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে রেস্টুরেন্টে পঁচিশ শতাংশ ছাড়ে খাবার মিলছে আজ। ছাড় পেলে বাঙালির অবস্থা কীসে উন্নীত হয় তা তো খোলে বলতে হয় না। তাই, অনেকে কোনো আয়োজন ছাড়া, নেহায়েত বাসায় রান্নার ঝামেলা এড়াতে এখানে খেতে চলে এসেছে। সম্ভব হলে ফিরতি পথে গিন্নীর জন্যও কিছুটা ছাড়ে পাওয়া কাচ্চি নিয়ে যাবেন।
বেশ খানিকটা ভিড় ঠেলেঠুলে রেস্টুরেন্টের ভেতরের একটা কামড়ায় আসলো আনিছ। স্বপন, মীরা, জাফর, সালাউদ্দীনকে দূর থেকে একটা টেবিলে বসা দেখে হাত উঁচু করে ইশারা করলো। ওরাও ওকে দেখে হাত উঁচিয়ে ধরেছে, সবার মুখে হাসি আর কী যেন বলছে। আশেপাশে এতো মানুষের ভিড়ে দূর থেকে ওদের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। আনিছ গিয়ে ওদের সঙ্গে টেবিলে বসতেই সবাই একযোগে, 'হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু, হ্যাপি বার্থ ডে টু য়্যু' বলে বাচ্চাদের মতো গান শুরু করল। আশেপাশের টেবিল থেকে কয়েক জোড়া চোখ ওদেরকে দেখছে। আনিছ যেন কিছুটা বেকায়দায় পড়ে গেল এসেই। বললো, 'কী করছো। সবাই তাকিয়ে আছে। আমি কি আর বাচ্চা আছি? আমার জন্য বার্থডে গান গাইতে হবে না বুড়োর দল। তোমাদের অবস্থা কী বলো, কিছু অর্ডার করেছ?' পাশ থেকে মীরা বললো, 'পুরোনো শার্টটাই পরে আসলে? কাল যে আমি আর স্বপন তোমার জন্য শার্ট কিনে উপহার পাঠালাম আজকের দিনে অন্তত ওটা পরে আসলেও পারতে। নাকি পছন্দ হয়নি।'
আনিছ মুখে কিছু বললো না। শুধু হাসলো। এরা মিলির ব্যাপারে কিচ্ছু জানে না। শুধু এরা নয়, অফিসের কেউই মিলির ব্যাপারে কিছু জানে না। মিলি ছিল আনিছের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত একটা জীবন্ত গল্প। যতোদিন ছিল সে গল্পে নবরস ছিল। চলে যাওয়ার পর এটা একটা পড়ে ফেলা পরিত্যক্ত পুরোনো মলাটের বইয়ের মতো হয়ে গেছে। যা এখন অন্য কেউ পরছে। আনিছের জন্য শুধুই করুণরসের এক অতীত গল্প হয়ে আছে মিলি। শার্টের ইস্যুটি পাশ কাটিয়ে আনিছ বললো, 'এসব ছাড়ো। আজকে রেস্টুরেন্টে ভিড় দেখেছো? এমন ভিড় কখনো হয় না। চলো অর্ডার করে ফেলি। রাত যত বাড়বে কাস্টমার আসতেই থাকবে। পরে ওয়েটিং লিস্টে পড়ে যাব। কে কী খাবে তাই বলো?'
স্বপন বললো, 'কী আবার? কাচ্চি ভাইয়ে এসে তো কাচ্চিই খাব। দেখো না সবার প্লেটেই কাচ্ছি।'
আনিছ একজন ওয়েটারকে ডেকে পাঁচটা ফুল প্লেট কাচ্চি আর সাথে সফট ড্রিংকস দিতে বললো। অর্ডার শেষ করে আবার গালগল্পে মশগুল হয়ে গেল সবাই। আনিছ সবাইকে রুস্তমের কথা বললো। কিন্তু, কেউ তেমন গুরুত্ব দিল না। বরং, আজকে জন্মদিনের বিশেষ রাতটি বয়সকালেও ব্যাচেলর আনিছ কী করে কাটাবে তা শুনতে আগ্রহী বেশি। অবশ্য, আনিছ ওদেরকে বলেছে, এ নিয়ে বিশেষ কোনও ভাবনা নেই। যেভাবে প্রতিদিন কাটায় সেভাবেই কাটাবে। অর্থাৎ, একা বাসায় ফিরে ল্যাটা মেরে শুয়ে পড়বে। শুক্রবারে অফিস নেই। তাই এদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে। বিকেলের দিকে একটু নীলক্ষেতের দিকে যাবে কয়েকটা বই আনতে। জাফর মাঝে বলে উঠলো, 'আনিছ ভাই যদি চান, আমি অন্য ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমার হাতে ভালো মাল আছে কিছু।' বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো জাফরসহ সবাই। সবাই জানে, জাফরটা হলো একটা আস্ত নির্লজ্জ। ওকে মীরজাফর বললে মীরজাফরের এখনকার বংশধরেরা হয়তো লাঠি নিয়ে তেড়ে আসবে মারার জন্য। কারণ, মীরজাফর মীরজাফরি করলেও মীরার বন্ধু জাফরের মতো বেটিবাজি করেছে কি-না সন্দেহ। রাতেবিরাতে মেয়েছেলে নিয়ে ঘুরেবেড়াতে ওর বাধে না। বরং, পরদিন অফিসে এসে আনিছদের কাছে রগরগে বর্ণনা করে প্রতিটা বিষয়ের। মেয়েটির কোথায় তিল আছে, মেদ বেশি না কম, কোথায় আরেকটু মাংস থাকলে ভালো হতো— এ ধরনের নানা নোংরা কথা। অবশ্য জাফর এগুলোকে বলে, 'রোমান্টিক আলাপ'।আনিছের এসব কথায় কান থাকে না। তবু, কাছে বসে কেউ এমন বর্ণনা দিতে থাকলে অস্বস্তি লাগে। আনিছ বললো, 'না ভাই। আমার ওসব লাগবে না। তোমার মাল তোমার কাছেই রাখো। তোমরা যে আমার জন্মদিনটা মনে রেখেছো আর আজকে এখানে সবাই মিলে উদযাপন করছি এতেই আমার ঢের আনন্দ হবে। তা তোমরা আজকে গিফট না দিয়েই জন্মদিনের পার্টি খেতে এলে নাকি?' কথাটা বলে জাফরের দিকে তাকিয়ে হাসি দিল আনিছ। স্বপন আর মীরা গতকালই একটা শার্ট গিফট পাঠিয়েছে ওর জন্য। আজকে পরে আসার জন্য। যদিও পরে আসেনি। কিন্তু, বাকিরা এখনো কিছু দেয়নি। জাফর বললো, 'চার বছর পরপর আপনার জন্মদিন আসে। এমন দিনে উপহার কিছু না নিয়ে ক্যামনে আসি ভাই? এই নেন আপনার গিফট।' বলেই সুন্দর কাগজ দিয়ে রেপিং করা একটা বাক্স টেবিলের উপরে রাখল জাফর। ভেতরে কী আছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে, বাক্সটা বেশ সুন্দর করে রেপিং করা হয়েছে। দেখে ভালো লাগলো আনিছের। সালাউদ্দীন উপহার দিল একটা রোলেক্সের ঘড়ি। সাদাসিধা একটা বাক্সে করে এনেছে ওটা। ঘড়িটা কালো রঙের চামড়ার বেল্টের। এটাও পছন্দ হলো আনিছের।
উপহার দেওয়া-নেওয়ার মধ্যেই অর্ডারের খাবার এসে গেল। টেবিলটা ভরে গেল কাচ্চির মাখালো গন্ধে। জাফর তো উদ্ভট সব শব্দ করে করে কাচ্চি ডাইনের গুণকীর্তন করতে লাগলো। মীরা তা দেখে বললো, 'এবার থাম না। খাবার এসেছে খা। এতো কেন বকছিস। কাচ্চি ভাই তোকে এই চেঁচিয়ে গুণকীর্তন করার জন্য এক থালাও বেশি কাচ্চি দিবে না।' জাফর কথা থামিয়ে খাওয়া শুরু করলে অন্যরাও খাবারে মনযোগ দিল। সারা রেস্টুরেন্ট ভরে আছে মানুষে। বেইলি রোডের এই ছয়তলা ভবনের চারতলা জুড়ে শুধু রেস্টুরেন্ট আর ক্যাফেটেরিয়া। এরমধ্যে কাচ্চি ডাইনে ভিড় বেশি। ক্যাফেটেরিয়ায় তো আসলে যায় কপোত-কপোতীরা। যাদের একটু 'প্লেস' দরকার। আনিছদের মতো জীবনের পোড় খাওয়া মানুষ ওসব জায়গায় গিয়ে আনন্দ পাবে কীসে? যেতো তখন, যখন মিলি ছিল। তখন ওদেরও মাঝেমধ্যে 'প্লেসে'র দরকার পড়ত। মিলি এখন অন্যের ঘরে পুরোদস্তুর বউ। বিলেতে থাকছে স্বামীর সঙ্গে। জন্মদিনের এমন সন্ধ্যায় আজকে বারবার মিলির কথা মনে পড়ছে কেন ওর?
নিচে হট্টগোল শোনা গেল। যেন অনেক লোক একসঙ্গে কোনও কারণে চিৎকার, চেঁচামেচি করছে। 'হলোটা কী এতক্ষণ তো সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল।' গলার স্বরে সন্দেহ মিশিয়ে কথাটা বললো আনিছ। পাশ থেকে জাফর বলে উঠল, 'কী আর হবে ভাই। নিচের ক্যাফেতে পুলিশ অভিযান দিছে মনে হয়। দুইদিন পরপর অভিযানে আসে আর বড়লোক দেইখা দেইখা ছেলে-মেয়েরে ধরে নিয়ে যায়। আজকেও হয়তো অভিযানে আসছে।এইকারণে চিল্লাচিল্লি শুরু হয়েছে।' কিন্তু, জাফরের কথাটি আনিছের মনোঃপুত হলো না। পুলিশ অভিযান দিলে সাধারণ ক্রেতা চেঁচাবে কেন? আর হট্টগোলটা স্বাভাবিক বলেও মনে হচ্ছে না। ওর রুস্তমের কথা মনে পড়লো কেন যেন। রুস্তমকে বেশি টাকা দিতে চেয়েছিল। ছেলেটা নেয়নি। বললো, আজকে নাকি ওর মনে সায় দিচ্ছে না। সাবধান থাকতে বলেছে। কেন সাবধানে থাকতে বলেছে? আজকে কী খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে আনিছের সাথে? অবশ্য, এখানে খারাপ কী ঘটবে ওর সঙ্গে? তবু একবার বাইরে গিয়ে হট্টগোলটা দেখে আসবে কি-না ভাবে আনিছ। চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, মীরা হাত দিয়ে টেনে আবার বসিয়ে বললো, 'এতো স্বাদের কাচ্চি রেখে কই যাও? একবারে শেষ করে তারপর ওঠো।' আনিছ স্বপনের দিকে তাকায়। স্বপনের মুখ ভর্তি কাচ্চি। সে কথা বলতে না পারলেও মুখ দিয়ে ইশারায় বলতে চাইল, মীরার কথাই শেষ কথা। খেয়ে তারপর ওঠা। ওরা কী অস্বাভাবিক হট্টগোলটা শোনতে পাচ্ছে না? আনিছের মনের এই কথাটাই যেন বুঝে ফেলল মীরা। বললো, 'বাইরে মনে হয় কোনো ঝামেলা হচ্ছে। একারণে চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। আমাদের এখানে কোনো সমস্যাও নেই। খাবারটা শেষ করো আগ। তারপর দেখা যাবে।' শেষের কথাগুলো আর বলতে পারল না মীরা। একটা সিকিউরিটি গার্ড বিপর্যস্ত অবস্থায় চিল্লাচিল্লি করে কী যেন বলতে লাগলো রেস্টুরেন্টে ঢুকে। তার চোখেমুখে, ভাবভঙ্গীমায় জগতের সকল ভয় যেন আঁকড়ে ধরেছে। ওর মুখ থেকে শুধু একটা শব্দ বোঝা গেল, 'আগুন, ভয়াবহ আগুন।' ব্যাস পুরো রেস্টুরেন্টে জুড়ে শুরু হয়ে গেল মানুষের হল্লা।যাদের পাতে খাবার ছিল তা রেখেই দরজার দিকে ছুট লাগালো তারা। কিন্তু, দরজা পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেল। বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। আগুন ততোক্ষণে কাচ্চি ডাইনের ডোরের কাছে দাউদাউ করে জ্বলছে। বিকট সব বিস্ফোরণের শব্দ হচ্ছে। যেন ট্রাক, লড়ি, বাসের চাকা ব্লাস্ট হচ্ছে। আনিছ ওঠে দরজার কাছে গিয়ে ঘটনা বুঝবার চেষ্টা করলো। তাকিয়ে দেখে টেবিলে মীরা, স্বপন, জাফর, সালাউদ্দীন কেউ নেই! কোথায় গেলো ওরা! ভাবার সময় পায় না আনিছ। কেননা, ততক্ষণে মানুষের মুহুর্মুহু চিৎকার আর কান্না শুরু হয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে কম করে হলেও দেড়শ-দুশো মানুষ আছে। এরমধ্যে কেউ কেউ হট্টগোল শোনার পরেই বাইরে চলে যেতে পেরেছে। কিন্তু, আনিছের মতো যারা হট্টগোল কিসের তা ভাবতে ভাবতে কাচ্চিই খাচ্ছিল তারা আটকে গেল ভেতরে। এখন আনিছ বুঝতে পারছে পূর্বে শোনা হট্টগোলটা কীসের ছিল! আগুন নিচ থেকে লেগে এখন উপর অব্দি চলে এসেছে। সবদিকে লাল লেলিহান আগুন। আগুনের ফুলকিতে অন্যসব আলো যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। আনিছ বুঝতে পারে না কী করবে? তার কী করা উচিত। দৌড় দিয়ে দরজার কাছে আসে। কিন্তু, দরজায় মানুষের ঠেলাঠেলি এতো যে এদিক দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। তাছাড়া, দরজার দিকটায় আগুন লেগে বন্ধ হয়ে আছে। ওদিকে কেউ যেতে পারছে না। সবাই উদ্ভ্রান্তের মতো রেস্টুরেন্টের ভেতরে ছুটোছুটি করছে প্রাণ নিয়ে। মূহুর্তের মধ্যে কী হয়ে গেল যেন কেউ বুঝতেই পারছে না। একটু আগে এখানে সবাই গল্পগুজব করতে করতে খাবার খাচ্ছিলো, আড্ডা মারছিল। আনিছের জন্মদিন পালন হচ্ছিল। তারপর একটা হট্টগোল শোনা গেল। আর এর কিছু পরে চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন!
আনিছের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। জন্মদিনটাই কি শেষপর্যন্ত ওর মৃত্যুদিন হতে চলেছে? না না! আনিছ বাঁচতে চায়। ওর এখনো বিয়ে হয়নি। বিয়েটা মায়ের জন্য করেনি। মায়ের চোখের অপারেশন করাতে হবে আগে। এজন্যই তো এতো খেটেখুটে মরছে ঢাকা শহরে। মায়ের চোখটা অপারেশন করিয়ে সামনের ফাল্গুনেই হয়তো বউ ঘরে আনবে। কিন্তু, এ কী দেখছে চোখের সামনে আনিছ! সকল দোয়ার বন্ধ করে কেউ যেন ওকে যমের সামনে ছেড়ে দিয়েছে! আনিছের আরেকবার রুস্তমের কথা মনে পড়ে। রুস্তমেরও মায়ের চোখে অপারেশনের কথা বলেছিল! সাবধানে থাকতে বলেছিল! কেন বলেছিল? কে এই রুস্তম! আনিছ কিছু ভাবতে পারে না। এক দৌড়ে রেস্টুরেন্টের ছাদের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, নিরাশ হয়ে যায় ছাদ বন্ধ দেখে। সবাই বাঁচার চেষ্টা করছে। আগুনটা ক্রমশ বাড়ছে। আনিছ রেস্টুরেন্টে ঢোকার সময় বাইরে অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার রাখা দেখেছে। ওগুলো নিশ্চই আগুনকে আরও উশকে দিয়েছে। বাজেভাবে বিস্ফোরিত হবার আওয়াজ আসছে কানে। নাকে ভাসছে পোড়া গন্ধ। আনিছের মাথা যেন কাজ করে না। হতাশা চোখে নিয়ে আশেপাশে মীরাদের দেখা যায় কি-না খোঁজে। কিন্তু, লেলিহান আগুনে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, বোঝা যাচ্ছে না ওরা কী অবস্থায়া আছে। আনিছ দৌড় দিয়ে রেস্টুরেন্টের কিচেনে চলে আসে। রিসিপশনে কেউ নেই! নিশ্চয়ই আগুন লাগার পর সবাই পালিয়েছে। ভাগ্যিস, ওরা পালাতে পেরেছে। কিন্তু, আনিছদের কী হবে? কিচেনে কাউকে পায় না আনিছ। দেখে কিচেনেও আগুন পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে দ্রুত বের হয়ে আসে একটা ব্যালকনিতে। ব্যালকনি দেখে বুকে আশার সঞ্চার হয়। ভাবে এদিক থেকে কাউকে হয়তো সাহায্যের জন্য পাওয়া যাবে। কিন্তু, চোখ ধাধানো ভাবটা কাটলে আনিছ দেখলো, ব্যালকনিটা রেস্টুরেন্টের পেছনের দিকে। এখান থেকে কাউকে ডাকলেও শুনবে না। কারণ, এদিকটায় লোকজন থাকে না। আর আগুন ব্যালকনিতেও চলে এসেছে। এখানে অনেকগুলো পুরোনো সিলিন্ডার রাখা। বিস্ফোরণ হবার আগে এখান থেকে কেটে পড়ে আনিছ। যেখানে ছিল সেখানে ফিরে আসে ও। রেস্টুরেন্টের ভেতরটা এখন আর চেনা যায় না। মনে হচ্ছে, একটা ধ্বংসস্তুপ। মানুষগুলো এখনো প্রাণে বাঁচতে ছুটোছুটি করছে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। আগুনের তাপ যেন শ্বাসনালী পুড়ে ফেলছে এমনতর জ্বালা করছে। আনিছের দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। জোর করে নিজেকে টিকিয়ে রাখে। ওকে বাঁচতে হবে। আর কারো জন্য নাহোক, মায়ের জন্য বাঁচতে হবে। কিন্তু কীভাবে? অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। নাকে মুখে যেন কেউ লাল মরিচ গুলে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যদের মতো আনিছও কোনো পথ খুঁজে পায় না। বাইরে নিশ্চই এতোক্ষণে উৎসুক মানুষের ভির জমে গেছে। যে যা পারছে তা দিয়ে পানি ছেটাচ্ছে। কিন্তু, আগুন ততোক্ষণে সপ্তমে উঠে জ্বলছে। পুড়িয়ে নিচ্ছে সবকিছু। হয়তো মানুষও। আনিছ ভাবে, ফায়ার সার্ভিস নিশ্চয়ই এসেছে ওদেরকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু, এখনও তো কেউ পৌঁছল না এসে। আনিছ কী করবে ভেবে পায় না। নির্ঘাত মৃত্যুর দিকে যেন এগিয়ে যাচ্ছে আনিছসহ আরও অনেকে। আগুনের দাহ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
এরমাঝে একটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখলে সে। যে ব্যালকনিতে আগে গিয়েছিল সেখানে একটা লোকের গায়ে আগুন লেগে গেছে। লোকটা পুড়ছে আর 'বাঁচাও বাঁচাও' বলে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু, সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই সবার জান নিয়ে বেফানা। শুধু আনিছের চোখে দৃশ্যটা ধরা পড়েছে। লোকটা আগুন ধরা শরীর নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে আনিছদের দিকে আসতে চাইছে। কিন্তু, আগুনে পোড়ে যাওয়ার কারণে হয়তো বেদিশা হয়ে গিয়ে এখানে ওখানে ধাক্কা খাচ্ছে। লোকটা মেঝেতে পড়ে চেঁচাচ্ছে। একটু পর চেঁচানো আর শোনা গেল না। শুধু দেখা গেল, একটা মানুষের শরীরের মতোন জিনিস পুড়ছে দাউ দাউ করে। ভয় আর উৎকণ্ঠায় আনিছ কিছুই ভাবতে পারছে না। হয়তো আনিছও পুড়ে মারা যাবে। একটু আগে একটি লোক যেভাবে পুড়ে মরল। একটা লোক উৎকণ্ঠিত অবস্থায় এসে কাঁদতে কাঁদতে আনিছকে বললো, 'ভাই প্লিজ আমার বাসার নম্বরে একটা কল দিয়া জানান। আমি বিপদে আছি। একটু পরেই মারা যাব। আমারে জানি মাফ কইরা দেয়।' বলেই লোকটা হো হো করে কান্না শুরু করলো৷ আনিছেরও এক অবস্থা। আশেপাশে আর কাউকে তেমন দেখা যাচ্ছে না। অনেকে এরিমধ্য শ্বাসনালী পুড়ে মরে গিয়েছে। কেউ আগুনে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আনিছ দেখলো ওই লোকটি আর সে ছাড়া আর কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আনিছের ভেতরে এক অজানা ভয় এসে ধাক্কা দেয়। আর কোনো উপায় নেই বাঁচবার? নিজের মনকে মনেমনে প্রশ্ন করে অসহায়ভাবে। যেন নিজের কাছেই সরল আত্মসমর্পণ করছে ও। আনিছ কয়েকবার 'বাঁচাও বাঁচাও' বলে নিস্ফল চিল্লাতে থাকে। কেউ শোনে না। বাইরে নিচ থেকে অজস্র উৎসুক মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে। যেন কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও এসেছে। পাইপ দিয়ে পানি নেভাচ্ছে তারা। ছয়তলা ভবনের পুরোটাতেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আগুনের প্রচণ্ড তাপে কাছে ঘেষতে পারছে না দমকলকর্মীরা। এতোসবের মধ্যে কেউ আনিছের বাঁচার আকুতি শুনতে পায় না। কেউ একজনও যদি শুনে হয়তো বাঁচাতে এগিয়ে আসবে ওদেরকে— এ আশায় চেঁচাতে থাকে আনিছ। নাহ! কোনো লাভ হয় না এতে। পাশের লোকটির কান্নারত অবস্থায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। আনিছ দেখছে কাছে দাঁড়িয়ে কিছু করতে পারছে না। ওর নিজেরও শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে। রেস্টুরেন্টের টয়লেটের এদিকটায় এসে দাঁডিয়েছিল ওরা। এখানে শুরুতে আগুন ছড়িয়ে না পড়লেও এখন এখানে আগুন এসে পৌঁছে গেছে। দাউদাউ করে পুড়ছে সব। আর যখনই একেকটা সিলিন্ডারে আগুন লাগছে বিকট শব্দ তোলে তা বিস্ফোরিত হচ্ছে। আর প্রতিবার বিস্ফোরণের পর আগুনের শিখা যেন দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। আনিছ টের পায় ওর মাথার উপরটায় অতিরিক্ত গরম লাগছে। উপরে তাকিয়ে দেখে কাঠের রেলিংয়ে আগুন লেগে তা ছাদ ছুঁয়েছে আর সেই আগুন আনিছের মাথার কাছে এসে গেছে। আর একটু পরেই ওর শরীর স্পর্শ করবে। বাঁচবার কোনো পথ থাকবে না তখন আর। পাশের কান্না করা লোকটা মনে হয় মরে গেছে। আনিছের পাশেই পড়ে আছে লোকটা। নিথর, কোনো নড়নচড়ন নেই। আনিছ একলা আরও কয়েকবার বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে চেঁচায়। কেউ তা শুনতে পায় না। যদিও উদ্ধার কাজ চলছে। কিন্তু, আনিছকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসে না।
আনিছ শার্ট-প্যান্টের পকেট হাতড়ে মোবাইলটা বের করে। আম্মা লেখা নম্বরে একটা কল দেয়। হয়তো শেষ কল। একবার রিং বাজতেই কল রিসিভ হয়। হন্তদন্ত এক মহিলার গলার স্বর শোনা যায় ওপাশ থেকে। তিনি বলছেন, 'আনিছ বাপ। তোর কিছু হয় নাই তো? সকাল থিকা মনটা আজকে কেমুন জানি করতেছে। তুই কই বাপ? তুই একটু বাড়িতে আইবার পারবি? ক্যান জানি তোরে দেখবার ইচ্ছা হইতেছে বারবার। বাপ তুই কথা কস না ক্যান? ও আনিছ, আনিছ!'
আনিছ এপাশ থেকে কোনো কথা বলতে পারে না। ওর চোখ ভরে ততক্ষণে কান্না চলে এসেছে। ও কাঁদতে শুরু করেছে। মায়ের কথার কোনো জবাব দিতে পারে না। ভাবে, সন্তানের বিপদ মায়েরা কীভাবে আগেই টের পেয়ে যায়? আগুনের তাপে আনিছের বুক ফেটে গুর্দা বাইরে চলে আসতে চায় যেন। শ্বাস আর নেওয়াই যাচ্ছে না এতো বিষাক্ত হয়ে গেছে। হাতপা অবশ হয়ে আসতে চাইছে। আর বেশিসময় টিকতে পারবে না। আনিছ এপাশ থেকে মাকে শুধু একটি কথাই বলে— 'আমি তোমার চোখ ভালো করতে পারলাম না আম্মা। আমারে মাফ কইরা দিও৷ তোমারে শেষ দেখাটাও দিতে পারলাম না। আর কোনোদিন দেখা হবে না। আম্মা, আম্মা, ও আম্মায়ায়ায়া.....
ফোনটা কেটে যায়। আর কিছুই শোনা যায় না। না এপাশে, না ওপাশে। দূর থেকে দেখা গেল, আগের লোকটার মতো আরেকটা মানুষের শরীরের মতোন কী যেন আগুনে পুড়ছে। ওই শরীরের গায়ে পরা একটা নীল রঙের শার্ট! আর পাশেই পুড়ছে সদ্য উপহার পাওয়া রেপিং করা দুইটি বাক্স।
০২ মার্চ ২০২৪
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
লেখকের আরও গল্প পড়ুন- দি আউট সাইডার: মুনতাসীর মামুনের লেখায় কাম্যুর দর্শন পাঠ
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা