হেলাল আহমেদ, আই নিউজ
আপডেট: ১৯:১৮, ৩১ মে ২০২৩
তামাক দারুণ অর্থকারী, তবু বিষ : বর্তমান ও ভবিষ্যত
তামাক একটি অন্যতম নেশা জাতীয় অর্থকারী ফসল। তামাক যেমন অপকারী, আছে তামাকের উপকারিতা-ও। বিভিন্ন দেশে তামাকের বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার রয়েছে। সাধারণত, সিগারেট, বিড়ি, পাইপ ও হুক্কা, জর্দা, দোক্তা, খৈনী এবং নাকে দেয়ার নস্যি, দাঁত মাজার জন্যে গুল ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে তামাক উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তামাক ভিজানো পানি কীটপতঙ্গ দমনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া, তামাককে ঘিরে যে বিশাল বাজার এবং প্রক্রিয়া এখানে জড়িত আছে হাজারও মানুষ। তামাককে কেন্দ্র করে তাদের আয়, রোজগার হচ্ছে।
কিন্তু বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই তামাক চাষ কিংবা বিক্রি, তামাক গ্রহণে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তামাকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেক মানুষের জীবন ধারণের মতো একটি বিষয়ের বিরুদ্ধে কেন সারা বিশ্ব সরব?
আজ বিশ্ব তামাক দিবস-২০২৩ সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে একযোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ বছর প্রাতিপাদ্য রেখেছে- উই নিড ফুড, নট টোবাকো (আমাদের খাদ্য প্রয়োজন, তামাক নয়)। প্রতি বছরই এমন সময় উপযোগী স্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। আই নিউজের আজকের এই আর্টিকেলে আমরা তামাক নিয়ে কিছু বিষয় জানবো। বাংলাদেশে কোথায় তামাক চাষ হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব এবং তামাক শিল্পের সাথে সম্পৃক্তদের মতামতসহ আনুষাঙ্গিক আরও বহুকিছু। তাই পুরো আর্টিকেলটি পড়ার চেষ্টা করুন।
বিশ্বের তামাক চাষের শীর্ষে আছে চীন। আর বাংলাদেশের অবস্থান ভূমির তুলনায় ষোলতম। বাংলাদেশে তামাকের তিনটি জাত (ভার্জিনিয়া, মতিহারি ও জাতি) বিভিন্ন জেলায় চাষ করা হয়। এরমধ্যে ভার্জিনিয়া ৭৮ হাজার ১৯২ একর জমিতে, মতিহারি ২০ হাজার ২২ একর এবং জাতি ১৪ হাজার ৭১৩ একর জমিতে উৎপাদন হয় (সূত্র: বণিকবার্তা)। এসব তামাকের বেশিরভাগটাই চাষ হয় দেশের উত্তরবঙ্গে এবং পার্বত্য অঞ্চলে। তবে এসব ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রংপুর বিভাগের রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট এবং নীলফামারী জেলাগুলো এবং নেত্রকোনায় সাম্প্রতিক বছরগুলিতে তামাকের চাষ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বাংলাদেশে তামাক চাষে আগ্রহের কারণ
দেশে তামাকের বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার করাসহ নানা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হলেও দেশের ক্রমশ নতুন নতুন জেলায় বাড়ছে তামাক চাষ। বিশেষ করে রংপুর জেলায় আগের চেয়েও অনেক কৃষক নতুন করে তামাক চাষে যুক্ত হচ্ছেন। কারণ হিসেবে তারা দেখাচ্ছেন, অন্যান্য ফসল উৎপাদনের তুলনায় তামাক উৎপাদনে ঝুঁকি কম। ঝুঁকি মূলত আর্থিক লোকসানের।
তামাক চাষের সাথে সম্পৃক্ত কৃষকরা বলছেন, সাধারণত আলু বা অন্যান্য অর্থকারী ফসল উৎপাদন করলে এগুলো মজুদ করার জন্য একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সময়মতো কার্যকরী উপায়ে আলু বা উৎপাদিত ফসল নষ্ট হয়ে যায় অনেকসময়। এসব ফসল সাধারণত দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণ করা যায় না ফলে পচে নষ্ট হয়ে যায়। আর একবার ফসল নষ্ট হয়ে গেলে সেই ফসল আর কোনো ব্যবসায়ী কিনবেনই বা কেন? সেই তুলনায় তামাক চাষে ঝুঁকি কম। বছরের পর বছর তামাক ঘরে বা যেকোনো জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা যায়। বাজারের পরিস্থিতি দেখে পরে বাজারে বিক্রি করতে পারেন তামাক চাষীরা।
রংপুর অঞ্চলের তামাক চাষীদের কাছে অন্যান্য ফসলের তুলনায় তামাক বেশি লাভজনক। এতে পরিবহণের ঝামেলা চাষীদের নিতে হয়। বাড়তি সুবিধা হিসেবে অনেক সময় ক্রয় করে যেসব বড় বড় কোম্পানি তাঁর তামাক পচে গেলেও ক্ষতিপূরণ দিয়ে চাষীদের উৎসাহে রাখে।
তবু কেন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তামাক চাষীরা
তামাক একটি অর্থকারী ফসল। তামাক কোম্পানিগুলো বছরে তামাক বিক্রি করে কোটি আয় ও মুনাফা করছেন। সরকারকে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব দিচ্ছে এসব তামাক কোম্পানি। এই পরিমাণ রাজস্ব আর অন্য কোনো খাত থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এককভাবে পায় না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে এই শিল্পের সাথে জড়িত কৃষকরা বিকল্প পেশার দিকে ঝুঁকছেন। তারা বীজজাতীয় অন্যান্য শাকসবজি উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন। উত্তরবঙ্গ তামাক চাষের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি বড় ক্ষেত্র; সেখানেও কৃষকদের মধ্যে নিরুৎসাহিত মনোভাব এসেছে তামাক চাষের ক্ষেত্রে।
কিন্তু যে কারণে তামাক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কৃষকরা সেটির অন্যতম কারণ পানির অভাব। তামাক চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি সরবরাহের প্রয়োজন। তাছাড়া, সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে তামাকের বাজার এটি একটি ব্যয়বহুল বাজারে পরিণত হচ্ছে। তামাক থেকে বড় কোম্পানিগুলো বিশাল অঙ্কের টাকা লাভিয়ে নিলেও মূলত প্রান্তিক তামাক চাষীরা সে লাভের তেমন কিছু গুণতে পারেন না। আর দীর্ঘদিন তামাক চাষের ফলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা নষ্ট হয়ে অন্যান্য ফসল ফলানোর পুষ্টিগুণও মাটি হারিয়ে ফেলে। ফলে এখন চাষীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তামাক চাষে অনাগ্রহ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রংপুর দেশের অন্যতম দরিদ্র অঞ্চল। দেশের এই অঞ্চলে কৃষি উন্নয়নের স্বার্থে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এখন আর এই প্রকল্পটি খুব একটা কাজে আসছে না যার অন্যতম প্রধান কারণ তিস্তায় পানির স্বল্পতা। এছাড়া এই অঞ্চলটি অত্যন্ত নদী ভাঙ্গন প্রবন এলাকা, যা সম্প্রতি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের করা বাংলাদেশের দুর্যোগ মানচিত্রেও স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
তিস্তায় পানি স্বল্পতার কারণ উত্তরবঙ্গে বিস্তৃত পরিসরে তামাকের চাষ। আগেই বলা হয়েছে তামাক চাষের জন্য অনেক পানি লাগে। তাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিক্ষকরাও ইদানিং বলছেন- উত্তরবঙ্গের কৃষকদের উচিৎ এমন কিছুর চাষ বা আবাদ করা যা স্বল্প পানিতে উৎপাদন করা যায়। তা নাহলে এসব অঞ্চলে নদী ভাঙণ রোধ সম্ভব হবে না।
তামাক নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাবনা
বাংলাদেশ সরকার যদিও তামাক শিল্প থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব পেয়ে থাকে তবু স্বার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তামাকের কারণে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। অঙ্কের হিসেবে তামাকের কারণে দেশে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ (চিকিৎসা ব্যয় ও উৎপাদনশীলতা ক্ষতি) ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। যা আমাদের দেশের পদ্মাসেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে যে টাকা খরচ হয়েছে তার কাছাকাছি। তাই বাংলাদেশ সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ এশিয়ার স্পিকার সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আর এ ঘোষণার পর সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে শক্ত আইনও করেছে। কিন্তু তা স্বত্বেও, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ তামাক ব্যবহার করে এবং বছরে এর ফলে বাংলাদেশে ১৬১,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং রোগের চিকিৎসাজনিত খরচ বাবদ ৩০,০০০ কোট টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায় বলা হয়েছে তামাক চাষীদের প্রায় সকলেই ৩৩ শতাংশ কাশি এবং ২৯ শতাংশ হাঁপানি রোগে ভোগেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং স্থানীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বাংলাদেশে আগে তামাক চাষ এত ব্যাপক ছিল কারণ সরকারের রাজস্ব বিভাগ এটিকে উৎসাহিত করত। পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় তিনি খুশি। তিনি বলেন, “এখন সময় এসেছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তামাকের বিকল্পের বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নেয়ার।”
তামাকের অপকারিতা
তামাক পাতা চাষে কীটনাশকের ব্যবহারও খাদ্যফসলের তুলনায় বেশি। আশেপাশে নদীনালায় তামাকের বিষ গিয়ে মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি করছে। তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে গাছ ব্যবহার করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
উবিনীগের মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, এক বিঘা জমির তামাক পাতা শোধন করতে যে বিচালি লাগে, তা ৭০টা গরুর একদিনের খাদ্যের সমান। অর্থাৎ তামাক পাতা পোড়াতে গিয়ে গরুর খাদ্য কেড়ে নেয়া হচ্ছে। বান্দরবানের চাষীরা জানিয়েছেন, তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে এমন কোনো গাছ নেই, যা তন্দুরের কবল থেকে রক্ষা পায়। বনজ প্রজাতির সব গাছ ব্যবহার হয়। গর্জন, গামারি, জাম, কড়ই, আম, কাঁঠালসহ ঔষধি গাছও কেটে ফেলা হয়। একটি তন্দুরে এক মৌসুমে ২৪০ মণ কাঠের প্রয়োজন হয়, যা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মাঝারি আকারের গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয়।
একেকটি তামাক গ্রামে কয়েকশ তন্দুর থাকে। এভাবে তামাক এলাকায় বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক মূল্যবান গাছ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
মে মাসে বাংলাদেশে আঘান হানা সব ঘূর্ণিঝড়
তামাকের ক্ষতিকর দিক
যেসমস্ত বস্তুর ব্যবহার বাদ দিলে অকাল মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস করা যায় তামাক এর মধ্যে শীর্ষে। যত লোক তামাক ব্যবহার করে তার প্রায় অর্ধেক এর ক্ষতিকর প্রভাবে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬০ লাখ লোক তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায় (সর্বমোট মৃত্যুর প্রায় ১০%) যার প্রায় ৬ লাখ পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার।
বিংশ শতাব্দীতে তামাক প্রায় দশ কোটি ব্যক্তির মৃত্যু কারণ।একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (CDC) সেন্টারও এটাকে সারাবিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
তামাকের উপকারিতা
প্রাচীন একটি প্রবাদ আছে- সব জিনিসের ভালো এবং খারাপ দুইটি দিকই থাকে। আমাদের আর্টিকেলটি শেষের দিকে। তবে যেতে যেতে তামাকের ভালো দিক নিয়েও কিছু বলছি। ক্ষতিকারক এই তামাক পাতার রয়েছে একটি বিশেষ উপকারিতা।
সম্প্রতি এক গবেষণায় এমনটাই জানিয়েছে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অন্টারিও অ্যান্ড ল'সন হেল্থ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের একটি গবেষণাকারী দল। ওই গবেষক দলের দাবি, তামাক পাতায় থাকা থেরাপেটিক উপাদান টাইপ টু ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া, আর্থারাইটিস কমাতে খুবই কার্যকর।
আই নিউজ/এইচএ
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের