জাহাঙ্গীর জয়েস
আপডেট: ২২:২৪, ১ আগস্ট ২০২১
ভয়াবহ করোনাকাল এবং বেপরোয়া ভাব
এরাই এডিট করা অর্ধেক মুরগির এবং অর্ধেক সাপের মুখের ছবিও বিশ্বাস করে। এরাই অন্যান্য ধর্মের লোক কাতারে কাতারে ধর্ম পাল্টাচ্ছে এটা বিশ্বাস করে। কিন্তু এরাই চ্যানেলে চ্যানেলে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দেখছে অথচ বিশ্বাস করে না!
গত ২৮ জুলাই ২০২১ করোনায় রেকর্ড সংক্রমণ হয়েছে দেশে ১৬,২৩০ জন। ২৭ জুলাই রেকর্ড ২৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আজ (০১ আগস্ট ২০২১) ২৩১ জনসহ এতে মোট মৃত্যু দাঁড়ালো ২০,৭৭২ জনে। মোট সংক্রমিত ১২,৬৪,৩২৮ জন। অন্যদিকে বিশ্বে ৪২ লক্ষের ওপর মৃত্যু ও প্রায় ২০ কোটি লোক আক্রান্ত হয়েছেন।
২৪ ঘন্টায় যখন একটা পরিবার শেষ হয়ে যাচ্ছে। ১৬ ঘন্টার ব্যবধানে যখন এক এক করে ৩ ভাই চলে যাচ্ছে। একই দিনে যখন বাবা মা কিংবা মা-ছেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই যখন অবস্থা যে, একজন মারা গেলে অপেক্ষমান আরেকজন আইসিইউ বেড পাবেন।
এমতাবস্থায় যখন স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজন এবং প্রত্যেক স্তরের সচেতন ব্যক্তিবর্গ করোনার এই ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন তখনো জনগণের একটা বিরাট অংশ যেভাবে অবহেলা এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব দেখিয়ে যাচ্ছে- তা ভাবতেও অবাক লাগে।
সেদিন এক তরুণ কথা প্রসঙ্গে বললো, সে নাকি করোনা দেখছে না। আমাকে প্রশ্ন করলো, 'কোথায় করোনা?' আমি যখন থাকে বললাম, 'ক্যান্সার দেখা যায়? কিডনি, ফুসফুস, বাল্ব, হার্টের রোগ দেখা যায় নাকি হলে বুঝা যায়? তখন আর কোনো কথা বললো না।
অন্য এক জেলার একটা গ্রাম থেকে এখানে কৃষি কাজে এসেছেন কয়েকজন লোক। তাদের একজন বলছেন, তাদের এলাকায় এসব বিধিনিষেধ কেউ মানে না।
কিন্তু প্রায় দেড় বছর পরও লোকজন কেনো এমন অসচেতন বা বেপরোয়া? কোথায় সমস্যা?
এরাই তো ব্রিজের জন্যে মাথা লাগবে এটা বিশ্বাস করে। এরাই এডিট করা অর্ধেক মুরগির এবং অর্ধেক সাপের মুখের ছবিও বিশ্বাস করে। এরাই অন্যান্য ধর্মের লোক কাতারে কাতারে ধর্ম পাল্টাচ্ছে এটা বিশ্বাস করে। কিন্তু এরাই চ্যানেলে চ্যানেলে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দেখছে অথচ বিশ্বাস করে না!
প্রথম থেকেই একটা ডেমকেয়ার ভাব এবং সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যাচ্ছে। যেমন সরকারি পর্যায়ে তেমন সাধারণ মানুষের মধ্যে। সরকারের হাইপ্রোফাইল মন্ত্রী পর্যন্ত লাগামছাড়া কথাবার্তা বলা শুরু করলেন। কেউ বল্লেন, আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী। কেউ বল্লেন, করোনা প্রতিরোধে ঢাকা বিমানবন্দরের মতো ব্যবস্থা উন্নত দেশেও নেই। তো আরেকজন বল্লেন আমরা চীনের মতো হাসপাতাল বানাবো। অন্য আরেকজন বল্লেন, এটা এমন কোনো মারাত্মক রোগ নয়, সর্দি জ্বরের মতো।
এদিকে বিজিএমইএ অবিশ্বাস্য খেলা দেখিয়েই যাচ্ছে। তারা তাদের ক্ষমতার খেলাধূলায় সবকিছুকে তুচ্ছ করে কীভাবে শ্রমজীবী মানুষকে আধুনিক দাসে পরিনত করতে পারে তারা তা দেখিয়ে দিয়েছে। এদেরকে যে তারা মানুষ মনে করেনা তাতে সন্দেহ নেই। এদের তারা কেবল টাকা বানানোর মেশিন ছাড়া আর কিছু মনে করে না। দেশে বেশি বেকার থাকার এই এক দারুণ সুবিধা। তাদের যেকোনোভাবে কেনা যায়। পশুর মতো ব্যবহার করা যায়। যখন খুশি যেকোনো আদেশ নির্দেশ জারি করে এই লকডাউনেও তাদের বাধ্য করা যায় ট্রাক, ফেরি, রিকশা, অটো ইত্যাদিতে এবং মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে মানবেতর প্রাণীর মতো গাদাগাদি করে আসতে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক মঞ্জুরুল হক লিখেছেন, 'দাঁতাল শুয়োর আর ধূর্ত হায়নাদের লোভের জিহ্বা লকলক করছে! অসহায় সস্তা শ্রমিককে পণ্য বানিয়েছে আগেই, এখন বানিয়েছে দাস। প্রভু একবার হুকুম করে-করোনা বেড়েছে অমুক দিন থেকে সব বন্ধ। দাসেরা জীবন বাঁচাতে গ্রামে ছোটে। প্রভু আবার হুকুম করে- করোনা কমেছে-দাসেরা আবার হুড়মুড় করে কাজে যোগ দিতে ঢাকায় ছোটে। প্রভু আবার হুকুম করে- করোনা ভয়াবহ! এবার সব বন্ধ। দাসেরা আবার পড়িমরি করে মাখামাখি করে বাড়ি ছোটে। কারখানা বন্ধ। প্রভুদের ডলার আয় হচ্ছে না। প্রভুদের ডগিটার খাবার কিনবে কীভাবে? কারখানা খোলো। প্রভুরা যানবাহন বন্ধ রেখেছে অথচ দাসেদের আসার জন্য সমন জারি করেছে। দাসেরা আবার মাখামাখি করে যানবাহনের অভাবে গাদাগাদি করে ট্রাকে, অটোতে, রিকসায়, পায়ে হেঁটে কারখানায় ছুটছে.....
কোনো সভ্য দেশে বন্য প্রাণীও এভাবে পরিবহন হয় না! এখানে প্রভুদের বাণিজ্য সচল রাখতে দাসেদের কুকুর-শেয়ালের মত আসা-যাওয়া চলছে........।
এনাফ। আপনাদের এই 'খোলা-বন্ধ তামাশা' এবার বন্ধ করুন। আর নেওয়া যাচ্ছে না। টিভি চ্যানেলের লেকচার, প্রভুদের বাণী, নিকৃষ্ট যুক্তি আর দাসেদের নিয়ে এইসব নৃশংসতা আর কত? বিবেক-টিবেক তো বহু আগেই সুয়ারেজ লাইনে ঢেলে দিয়েছেন। অন্তত লজ্জা-শরম হোক আপনাদের।'
অন্যদিকে এক শ্রেণির ধর্মীয় বক্তা প্রথম থেকেই লাগামহীনভাবে বিকৃত, অর্ধ বিকৃত মনগড়া বক্তব্য দিয়ে একটা বাজে মনোভাব তৈরি করেছেন ধর্মভীরু সাধারণ মানুষের মধ্যে। একজন তো বক্তব্য দিয়ে দিলেন, মুসলমানের করোনা হবে না। মুসলমানের করোনা হলে কোরান মিথ্যে হয়ে যাবে। কী আজব অবস্থা! আর এদের বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ঘরে ঘরে চলে গেলো। মিথ্যে, কুযুক্তি, বিকৃতি, অপপ্রচার এখন হাতে হাতে। অনার্স, মাস্টার্স পড়ুয়ারা যখন 'এখন পর্যন্ত মাস্ক না পড়ে থাকা আমি' জাতীয় স্ট্যাটাস দিয়ে গর্ব করে তখন হুজুগে লোকজনের অবস্থা বুঝেন।
আবার সেই প্রশ্নে আসি- লোকজন কেনো এতো অসচেতন বা বেপরোয়া? কোথায় সমস্যা?
এজন্যে অসচেতন বা বেপরোয়া; এজন্যে সমস্যা যে, এরা অদৃষ্টবাদী। এরা বিজ্ঞানের সুযোগ সুবিধায় থেকেও বিজ্ঞানমনস্ক নয়। রাষ্ট্র তাদের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস থেকে বের করে আনতে পারেনি। একাডেমিকভাবেও আমাদের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিন কমছে। অন্যদিকে মানুষের অধিকার হরণকারী অপরাধী, দুর্নীতিবাজরা তাদের সীমাহীন অপরাধবোধ বা পাপবোধ থেকে ধর্মচর্চা আগের চেয়ে বরং বেশি করছে কিন্তু অপরাধ, দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসছে না। এরা এখনো বুক ফুলিয়ে বলছে, কপালে লেখা থাকলে মরবে! এদের কাছে কোনো বিধিনিষেধ নেই। যা কিছু মানামানি করে স্রেফ শাস্তির ভয়ে। আর শ্রমজীবীদের অসহায়ত্বকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো এই অতি লোভী অত্যাধুনিক মহাজনদের কথা আর কী বলবো!
এখানেই প্রশ্ন আসে, রাষ্ট্র কোন ধরনের মানুষ চায়? চলে আসে শিক্ষার প্রসঙ্গ। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা কী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ বানাতে পারছে? দেশে বিজ্ঞান চর্চার কী অবস্থা? বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনার কী অবস্থা?
রাষ্ট্র পরিচালকরাও জ্ঞানভিত্তিক, বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলেন। কিন্তু আসলেই কী তারা তাই চান নাকি শুধু কথার কথা?
গবেষণা, পরিসংখ্যান না খুঁজেও চোখ বন্ধ করে সেটা বুঝে নেয়া যায়। আপনার আশেপাশে যারা কথা বলেন, তাদের কথা শুনুন। সেখানে কী ফুটে ওঠে? সামরিক, স্বৈরাচারী আমল বাদ দিয়েও গত ৩০ বছর ধরে আপনার চারপাশে কয়টা স্কুল, পাঠাগার, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, খেলার মাঠ গড়ে ওঠেছে অন্যদিকে কতোটা মসজিদ-মন্দির-মাদ্রাসা গড়ে ওঠেছে? চোখ বন্ধ করে মিলিয়ে নেন।
একটা দেশে সংখ্যানুপাতিক হারে শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ অন্যান্য ধরনের পেশাজীবি থাকবেন এরকমই তো হওয়া উচিত। সুতরাং ধর্মগুরুদের সম্পর্কেও ভাবতে হবে এভাবেই। এবং অতি অবশ্যই বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে না হলে করোনা থেকে হয়তো আপাত রক্ষা মিলবে কিন্তু চিন্তার করোনা থেকে মুক্তি মিলবে না। মুক্তি মিলবে না আত্মবিধ্বংসী বেপরোয়া ভাব থেকেও।
জাহাঙ্গীর জয়েস, কবি ও লেখক।
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ

























