Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, সোমবার   ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫,   পৌষ ১৫ ১৪৩২

মায়মুন শরীফ রাইয়ান

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
আপডেট: ০৯:৫২, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও লেখক মায়মুন শরীফ রাইয়ান

কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও লেখক মায়মুন শরীফ রাইয়ান

নানা সন্দেহ, অবিশ্বাস আর প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সতেরো বছরের দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এটি কেবল একজন রাজনৈতিক নেতার দেশে ফিরে আসা নয়, বরং দীর্ঘদিনের দমন-নিপীড়ন, গণতান্ত্রিক সংকট ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার পর এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী 'নতুন বাংলাদেশ' এর প্রেক্ষাপটে তার এই রাজসিক প্রত্যাবর্তন রাজনীতিতে নতুন আশাবাদ, উদ্দীপনা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে আরও বেগবান করে তুলেছে।

এই প্রত্যাবর্তন ঘিরে ঢাকার রাজপথে যে ব্যাপক জনসমাগম ও চাঞ্চল্য দেখা গেছে, তা নিছক দলীয় শক্তি প্রদর্শন নয়। এটি ছিল সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার এক স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। বছরের পর বছর ধরে ভোটাধিকার হরণ, একদলীয় কর্তৃত্ববাদ, গুম-খুন, অর্থনৈতিক লুটপাট, বিরোধী মত দমনের উদগ্র রাজনীতি মানুষকে যে হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, তার বিপরীতে এই গণসংবর্ধনা নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার বার্তা বহন করে।

২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে লন্ডন যাত্রার মধ্য দিয়ে তারেক রহমানের যে নির্বাসিত জীবন শুরু হয়, তা ছিল অনিশ্চয়তা, অপপ্রচার ও দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে ভরা। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তথাকথিত 'মাইনাস ফর্মুলা' বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই মূলত তাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়। গ্রেফতার, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং একের পর এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে তার দেশে ফেরার পথ ক্রমশ রুদ্ধ করে দেয়া হয়।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই রাজনৈতিক আক্রোশ আরও ভয়াবহ ও নির্দয় রূপ ধারণ করে। উদ্দেশ্য ছিল- শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিবারকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ও অকার্যকর করে দেওয়া। বেগম খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করা, ক্যান্টনমেন্টের বাসভবন থেকে উচ্ছেদ, একের পর এক ভোটারবিহীন নির্বাচন- সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এক কর্তৃত্ববাদী ও মাফিয়া শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয়। ২০২৪ সালের তথাকথিত নির্বাচন ছিল সেই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যা কার্যত গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়।

এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যেই ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নতুন সম্ভাবনার জন্ম দেয়। ক্রমে তা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং নজিরবিহীন গণআন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদী শাসনের ভিত নড়ে যায়। শেখ হাসিনার ক্ষমতা ত্যাগ এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পলায়নের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিতে এক ঐতিহাসিক পালাবদলের সূচনা ঘটে। এই পুরো সংগ্রামের পেছনে নেপথ্য নেতৃত্ব, কৌশলগত দিকনির্দেশনা এবং সফল পরিসমাপ্তিতে তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

লন্ডনে অবস্থান করেও তিনি কখনো রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের সংগঠিত করা, জোটগত আন্দোলন সচল রাখা এবং গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে রাখার দায়িত্ব তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে পালন করে গেছেন। প্রায় ছয় হাজার তিনশ দিনের নির্বাসিত জীবনে থেকেও তাঁর দেওয়া প্রায় সাত হাজার বক্তব্য, অসংখ্য রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও মানবিক উদ্যোগ তাঁর অবিচল রাজনৈতিক সক্রিয়তার স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে।

২৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তারেক রহমানের অবতরণ তাই শুধু বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের কাছেও এক আবেগঘন ও ঐতিহাসিক মুহূর্তে পরিণত হয়। প্রিয় নেতার দেশে ফেরা ঘিরে রাজধানীজুড়ে যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা দীর্ঘ প্রতীক্ষা, বেদনা ও সংগ্রামের অবসানের প্রতীক হয়ে ওঠে। দেশে ফিরে অসুস্থ মা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ, পিতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত, জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং শহীদ ওসমান হাদীর কবর জিয়ারত সবকিছু মিলিয়ে রাজনৈতিক ও পারিবারিক উভয় অর্থেই গভীর প্রতীকী তাৎপর্য বহন করে।

এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামোতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের সঞ্চার হয়েছে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা, আত্মবিশ্বাস ও রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ সুস্পষ্ট। একই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নতুন সমীকরণ, যা ক্ষমতার ভারসাম্য ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে।

প্রত্যাবর্তনের দিনে তারেক রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণে ছিল না কোন অভিযোগ, প্রতিশোধের সুর কিংবা অতীতের ক্ষোভ। ছিলনা পারিবারিক স্তুতি আর গতানুগতিক বাগড়ম্বর বা উস্কানি। বরং তাঁর বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে শান্তি, স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির ভাবনা। বিভেদ ও হিংসার রাজনীতির পরিবর্তে জাতীয় ঐক্যের ডাক এবং সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ গড়ার আহ্বান তাঁর বক্তব্যকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। 'আই হ্যাভ এ প্ল্যান'- এই ঘোষণাটি রাজনীতি-সচেতন মহলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এটি নিছক কোনো স্লোগান নয়; বরং রাষ্ট্র সংস্কারের একটি সুসংহত ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা।

এই পরিকল্পনার কেন্দ্রে রয়েছে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থা, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা, জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ প্রশাসন, দুর্নীতিমুক্ত ও মেধাভিত্তিক রাষ্ট্রযন্ত্র, তরুণদের কর্মসংস্থান এবং উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। বছরের পর বছর ধরে চলমান বিভাজন ও অবিশ্বাসের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠনের যে স্বপ্ন তিনি তুলে ধরছেন, তা দেশবাসীকে আশাবাদী করে তুলেছে। শুধু কথার ফুলঝুরি বা আবেগী বক্তৃতা নয়, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর জোর দেওয়ার এই দর্শন শিক্ষিত সমাজ ও তরুণ প্রজন্মকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে।

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঘোষিত বিএনপির ৩১ দফা কর্মসূচি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত গবেষণা সেল ইতোমধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, আইসিটি, ব্যাংকিং ও শিল্প খাতের কাঠামোগত সংকট মোকাবিলায় বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করে যাচ্ছে। তারেক রহমান নিজেই স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি আর কল্পনার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নন; তিনি একটি সুস্পষ্ট, সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার মধ্যেই অবস্থান করছেন।

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে সৃষ্ঠ এই সম্ভাবনার পথ মোটেও সহজ বা মসৃণ নয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক স্থবিরতা ও গণতন্ত্রহীনতার ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে টেকসই গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। দেশি-বিদেশি নানা উস্কানি, বিশেষ মহলের অপপ্রচার, আধিপত্যবাদী শক্তির নীল নকশা মোকাবেলা, নতুন প্রজন্মের ভোটারদের প্রত্যাশা, নির্বাচনকালীন সহিংসতার আশঙ্কা, দলীয় ঐক্য অটুট রাখা এবং ২০২৬ সালের নির্বাচনে সাফল্য অর্জন- সব মিলিয়ে সামনে কঠিন ও জটিল সময় অপেক্ষা করছে। এমনকি নির্বাচনে বিজয় অর্জিত হলেও মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, উৎপাদন ও উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনা এবং ভিন্নমত ও ভিন্ন পথের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সহজ কোনো কাজ নয়।

সব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, তারেক রহমানের এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিনের স্বেচ্ছাচারী শাসন, রাষ্ট্রীয় অনাচার ও গতানুগতিক রাজনীতির আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কল্যাণরাষ্ট্র গঠনের যে স্বপ্ন তিনি উপস্থাপন করছেন, তা দেশবাসীর মনে নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। এই প্রত্যাবর্তন যেন ইতিহাসের এক স্পষ্ট বার্তা-মেঘের চাদর সূর্যের দীপ্তিকে চিরদিন আড়াল করে রাখতে পারে না। অসহিষনুতা, দলবাজি ও অস্থিরতার কালো মেঘ কাটিয়ে জনগণের সমর্থন, জাতীয় ঐক্য ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনার সমন্বয়ে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের যাত্রাপথে ফিরে আসতে পারে। আর সেই যাত্রার গন্তব্য নির্ধারণ করবে তারেক রহমানের নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন।


মায়মুন শরীফ রাইয়ান, লেখক-প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড মডেল কলেজ

 

ইএন/এসএ

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়